নবরূপে বিশ্ববেহায়া by এ জেড এম আবদুল আলী

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিলের খবর যেদিন বের হয়েছে, সেদিনকার অনেকগুলো খবরের কাগজ আমি দেখেছি এবং দেখে বিস্মিত হয়েছি। অনেক খবর, অনেক মন্তব্য প্রতিবেদন পড়েছি। পঞ্চম সংশোধনী বেআইনি ঘোষণার পর সপ্তম সংশোধনীও যে ওই একই পথে যাবে, তা মোটামুটি সবাই আমরা জানতাম। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি অন্য একটি কারণে। কোনো খবর, কোনো মন্তব্য প্রতিবেদনের কোথাও এ কথাটি উল্লেখ করেননি যে এরশাদ একজন ‘বিশ্ববেহায়া’। এই নাম তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর মৃত্যুর খানিক আগে। তাঁর দেওয়া এই নাম, তা যে কতখানি সত্য, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সপ্তম সংশোধনীসংক্রান্ত রায়টি যেদিন বের হলো, সেদিনই। আর কেউ কিছু বলার আগেই এরশাদ উচ্চকণ্ঠে স্বাগত জানালেন সেই রায়কে। অত বড় একটি অপকর্ম করে সেই অপকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে বললেন, হাইকোর্টের এই রায়ে তিনি খুশি। রায় তিনি মাথা পেতে নিচ্ছেন, কেননা তিনি আইন ও সংবিধানের শাসনে বিশ্বাসী! সেদিনই তাঁর দলের এক ইফতার অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ক্ষমতা গ্রহণের কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না। কিন্তু জাতির এক ‘ক্রান্তিকালে’ তিনি বাধ্য হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। কথাগুলো বলে তিনি প্রমাণ করলেন যে এরশাদ শুধু একজন বিশ্ববেহায়াই নন, একজন ‘বিশ্ব মিথ্যুক’ও বটে। ১৯৮২ সালের যে সময় তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন দেশে কোনো রকম ক্রান্তিকাল ছিল না। বরং সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। রাষ্ট্রপতি সাত্তার বেশ ভালোভাবেই দেশ পরিচালনা করছিলেন। ‘গালকাটা কামাল’, ‘ইমদু’ নামের অপরাধীকে পাকড়াও করে তিনি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্রব্যমূল্য ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমন সময় এরশাদ রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বন্দুকের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। যদিও তিনি এর আগে মাস দশেক থেকেই ষড়যন্ত্র করছিলেন, তবু এরশাদ বললেন, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য তিনি বাধ্য হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তাঁর কোনো রকম রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই! কিছুদিন পরই একটি নির্বাচন দিয়ে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা ত্যাগ করবেন।
এহেন ডাহা মিথ্যে কথা বলে তিনি পরবর্তী প্রায় নয় বছর ক্ষমতায় রইলেন। দুর্নীতি দমন করবেন বলে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি দেশটিকে একটি তস্করতন্ত্র বা ক্লেপ্টোক্র্যাসিতে পরিণত করলেন। এ দেশের আর একজন বহুরূপী রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদের মতো তিনিও মুখটি শুকনো শুকনো রেখে হাসি হাসি ভাব করে নানা রকম সিরিয়াস মিথ্যে কথা বলতে লাগলেন। রতনে রতন চেনে।
সেই মওদুদ আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি বানালেন এরশাদ। এমনিতেই তাঁর কুবুদ্ধির অভাব ছিল না, কিন্তু মওদুদ আহমদ এসে তাঁকে আরও কুপরামর্শ দিতে শুরু করলেন। অন্যায়ের ষোলকলা পূর্ণ হলো।
কী পারেন না এরশাদ? তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব। ১৯৯৬ সালে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টি নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধলেন এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলো। কিন্তু এরশাদের দল সেখানে এমনভাবে রইল যে শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে কোনো রকম অগ্রগতি করতে পারল না। এ ব্যাপারে এরশাদ তাঁকে কোনো রকম সহযোগিতা করলেন না। এর আগে তাঁর প্রায় নয় বছরের শাসনামলে তিনি ওই সব খুনিকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে থাকতে দিলেন। কারও বিরুদ্ধে কোনো রকম পদক্ষেপ নিলেন না।
এবার এরশাদের দল যথেষ্ট পরিমাণে আসন না পাওয়ায় তিনি রাষ্ট্রপতির পদ আদায় করতে পারলেন না। তা না হলে তিনি বলেই বেড়াচ্ছিলেন যে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। তাঁর মতে, ‘ওয়ান্স এ প্রেসিডেন্ট অলওয়েজ এ প্রেসিডেন্ট।’ তিনি শেষ পর্যন্ত মহাজোটে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরকে বাড়িতে ছোট মাছ দিয়ে ডিনার খাইয়ে আপ্যায়ন করেছেন। অর্থাৎ তিনি বরাবরই দুই নৌকায় পা রেখে চলেছেন। চরম সুবিধাবাদের এ রকম উদাহরণ আমাদের দেশের রাজনীতিতে আর মাত্র একজনই আছেন।
এখন কী হবে? এরশাদ সাহেব বলে বেড়াচ্ছেন, শেখ হাসিনা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, তাঁকে যাতে আর কোনো বিচারের সম্মুখীন না হতে হয়, তা তিনি দেখবেন। অন্যদিকে, অনেক অভিজ্ঞ আইনবিদই বলছেন, প্রচলিত আইনেই তাঁর বিচার সম্ভব। একজন আইনবিদ আনিসুল হক বলেছেন, মিলিটারি অ্যাক্টে তাঁর বিচার হওয়া সম্ভব। আমরা মনে করি, তাঁর বিচার হওয়া উচিত। তা সে যে আইনেই সম্ভব হোক। তিনি ইতিমধ্যে বিএনপির আমলে পাঁচ বছর জেল খেটেছেন। এবারও তাঁর কমপক্ষে একটি প্রতীকী শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি এক দিন হলেও যেন জেলে কাটান। এবং জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি যেন জনসমক্ষে তাঁর সব অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর প্রবর্তিত ‘রাষ্ট্রধর্ম’ যেন অবিলম্বে বাতিল হয়ে যায়। এ দেশে কোনো মানুষ যেন নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে না করে।
দেশে আবার সেনাশাসনের কথা অনেকে বলছেন, সেনাপতিরা যেহেতু সংবিধান দেখে ক্ষমতা গ্রহণ করেন না, সেহেতু ভবিষ্যতের সেনাদের অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কা থেকেই যায়। কথাটি ঠিক। তবে আমরা মনে করি, যদি এ রকম কোনো ম্যান্ডেটরি আইন করা যায়, যাতে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের কমপক্ষে ২০ বছরের জন্য জেলে যেতেই হবে, তাহলে এর প্রবণতা কমবে। পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো দেশে এ রকম ম্যান্ডেটরি প্রাণদণ্ডের বিধান রয়েছে। সেসব দেশে আইনে আছে, কারও কাছে একটি বিশেষ পরিমাণের বেশি মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে প্রমাণিত হলে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হবেই। বিচারকেরা চাইলেও তাঁর প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি দেখাতে পারবেন না। তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিতেই হবে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের যদি ওই রকম ম্যান্ডেটরি জেল খাটার শাস্তির বিধান করা যায়, তাহলে ওই ধরনের ক্ষমতা দখলের প্রবণতা কমতে বাধ্য। আমাদের দ্বিতীয় একটি প্রস্তাব রয়েছে। এরশাদ নিজে একজন প্রচণ্ড ইসলামভক্ত মানুষ। তাই তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন সেই ইসলামি শরিয়া আইনেই তাঁর শাস্তি হতে পারে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত।
আসলে আমার এত কড়া কড়া কথা লেখার উদ্দেশ্য একটাই—এ দেশের মানুষের মনে সচেতনতা তৈরি করা। গণতন্ত্রকে এভাবে বারবার জিম্মি করে রাখার অধিকার কারও নেই। অনেক আগে একটি ইংরেজি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। ডেসপারেট আওয়ার্স নামে ওই ছবিটিতে দেখিয়েছিল, কী করে তিনজন জেল-পালানো খুনি আসামি একটি বাড়িতে ঢুকে লোকজনকে জিম্মি করে কয়েক দিন বাড়িটি চালিয়েছিল। তারা প্রতিদিন ওই বাড়ির একজন মানুষকে জিম্মি করে বাকি সবাইকে বাইরে বের হয়ে নিজ নিজ কাজে যেতে দিত। বাড়ির লোকজনকে বলা হয়েছিল, তারা যদি বের হয়ে কাউকে বলে যে তাদের বাড়িটি জেল-পালানো খুনিরা দখল করে রেখেছে, তাহলে বাড়ির জিম্মি ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হবে। এভাবেই ওই জবরদখলকারী খুনিরা গোটা বাড়িটাকে জিম্মি করে রেখেছিল। জোর করে ক্ষমতা দখলকারী—সেনাপতি জিয়া ও পরে এরশাদ—ঠিক ওই একইভাবে গোটা দেশকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। জিয়া, মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম কর্তৃক জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার কোনো পদক্ষেপ নেননি এরশাদ। জাতির জনকের ওই সব আত্মস্বীকৃত খুনিকে রাষ্টদূত পদে থাকতে দিয়ে যে অন্যায় তিনি করেছিলেন, তার জন্য কি কোনো শাস্তিই তিনি পাবেন না?
আমার বিশ্বাস, তা হতে পারে না। গণতান্ত্রিক কোনো দেশে বিচারের বাণী এভাবে কাঁদতে পারে না। এরশাদের বিচার এবং শাস্তি না হলে শহীদ নূর হোসেন, ডাক্তার মিলনদের আত্মার শান্তি হবে না, হতে পারে না।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.