আরেকটা ‘দায়মুক্তি’ আইন দরকার by শাহদীন মালিক

যে অভ্যাসটা জানি খারাপ কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিত্যাগ করা যায় না, সেটাকেই তো বলে ‘বদভ্যাস’।
জানি না, কত আইনজীবীর এই বদভ্যাস আছে। আশঙ্কা অনেকেরই, তবে আমার নিঃসন্দেহে আছে। বদভ্যাসটি হলো অযাচিতভাবে ‘আইনি উপদেশ’ দেওয়া। পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রায়শই তাদের সমস্যা নিয়ে বাতচিত করেন। বাতচিত, আলাপ-আলোচনায় অনেক আইনি উপদেশ দেওয়া হয়ে যায়। ছয় মাস, নয় মাস পরে ভীষণভাবে উপদেশ পাওয়া ব্যক্তি তার আসল আইনি সমস্যা নিয়ে হাজির হন। প্রায়ই দেখা যায় যেভাবে বলা হয়েছিল, সেভাবে ব্যক্তিটি কাজ করেননি। যেমন জমিজমা কেনা। পইপই করে বলে দিয়েছিলাম, কী কী করতে হবে, কী কী বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে হবে, কোন কোন কাগজ পরীক্ষা করতে হবে, বায়নাপত্র কীভাবে করতে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসবের বেশির ভাগ পদক্ষেপ ঠিকমতো না নিয়েই টাকা দিয়ে দিয়েছেন। টাকা গেছে, জমি আসেনি অথবা ঠিকঠাকমতো আসেনি।
বদভ্যাসটা হলো, প্রাথমিক ‘আইনি উপদেশ’টা বিলি করা হিয়েছিল বিনা পয়সায়। বিনা পয়সার উপদেশ নিয়ে কেউ বেশি মাথা ঘামায় না। যে কথাগুলো বলেছিলাম, তার জন্য নিদেনপক্ষে হাজার দুই টাকা চেয়ে আদায় করলে উপদেশগুলো মনে থাকত, সে অনুযায়ী কাজও হতো আর উপদেশ গ্রহীতার আম-ছালা দুটোই চলে যেত না।
বদভ্যাসটা আগেই বলেছি, সহজে পরিত্যাগ করা যায় না। তাই আবারও বিনা পয়সায় গায়ে পড়ে উপদেশ দিচ্ছি। আর উপদেশটা যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারকে জানান দিয়ে পত্রিকার মাধ্যমেই দিচ্ছি। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো আর বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন না যে সোজা চেম্বারে এসে হাজির হবে। তাই বদভ্যাসটা ফলাও করে ‘জাহির’ করছি।
বিনা পয়সার আইনি উপদেশটা হলো, আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য আরেকটা দায়মুক্তি আইন পাস করেন। যত তাড়াতাড়ি করবেন, ততই মঙ্গল।


হোরহে ভিদেল নামে মধ্য সত্তরের সময় আর্জেন্টিনার এক সামরিক শাসক ছিলেন। দেশের লাখ লাখ ফুটবলপ্রিয় আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ভিদেলের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। ভদ্রলোকের বয়স আশি পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে তার স্থায়ী ঠিকানা সে দেশের জেল। যাবজ্জীবন। তার বেশ কিছু অপকর্ম থেকে রেহাই দিয়েছিলেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট, ১৯৯০ সালে। ভিদেল সাহেবের আদেশে খুন হওয়া ব্যক্তিবর্গের নাছোড়বান্দা কিছু আত্মীয়স্বজন ও তাদের আইনজীবীরা লেগে রইলেন প্রায় দুই দশক ধরে। শেষতক বিবিসির কল্যাণে জানলাম, আর্জেন্টিনার সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতির ‘মাফ’ করাতে মাফ হয় না। ভিদেল সাহেবকে আরও গোটা ত্রিশেক খুনের দায়ে আবার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে যাবজ্জীবন জেলে থাকা অবস্থায়ও।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পরপরই তাঁর হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ সেনাবাহিনীর কাছে ‘হস্তান্তর’ করে, চট্টগ্রামে। ওই দিনই মেজর জেনারেল মঞ্জুর নিহত হন। সেই হত্যার জন্য প্রায় পনেরো বছর পর ১৯৯৫ সালে মামলা দায়ের হয়। বিচার শুরু হয়েছে, চলছে, তবে খুব ধীরগতিতে।
সেই হত্যা মামলার একজন আসামি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ভালো হতো এরশাদ সাহেব যদি মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যার ব্যাপারে একটা দায়মুক্তি আইন পাস করিয়ে রাখতেন তাঁর সংসদকে দিয়ে। কিসে কী হয়, বলা তো যায় না। তাই দায়মুক্তি আইনটা পাস করিয়ে রাখাই ভালো।
বিদগ্ধজন বলবেন, দায়মুক্তি আইনে তো লাভ নেই। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তো তাঁদের দায়মুক্তিতে পার পাননি। কথাটা ঠিক। কিন্তু বছর বিশেক তো বহালতবিয়তে ছিলেন সেই আইনের বদৌলতে। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ কথাটা কে না জানে।
এই সরকার তো মওদুদ সাহেবের পরামর্শ নেবেন না। নিলে ভালো হতো। কারণ অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শ আমার মতো বিনা পয়সার উপদেশ বিতরণকারী থেকে অনেক বেশি ফলদায়ক।
গালগপ্প মারি না, অর্থাৎ একটু-আধটু এদিক-সেদিক কস্মিনকালেও করি না, এমন কথা হলফ করে বলতে পারব না। তবে আইন উদ্ধৃত করতে এদিক-সেদিক করা যায় না। অতএব, আইনসংক্রান্ত নিচের অংশটি টু-হান্ড্রেড পারসেন্ট পাক্কা। সূত্র: বাংলাদেশ কোড, ভলিউম ৩৫, পৃষ্ঠা ৩১০-৩১২ থেকে। ২০০৩ সালে ১ নং আইন, এর ধারা (৩)-এর উপধারা (খ)তে আছে—
‘.....১৬ই অক্টোবর ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ বা তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা কার্যের দ্বারা কাহারও প্রাণহানি ঘটিলে কাহারও জান বা মালের কোনো ক্ষতি হইলে...বা কেহ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত...সরকার বা সরকারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বা সরকারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার দেওয়ানি বা ফৌজদারি মোকাদ্দমা বা কার্যধারা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা চলিবে না...।’
২০০৩-এর এই দায়মুক্তি আইনটি মাস তিনেক—১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত কৃত সব কার্যকলাপের জন্য। এখন ওই আইনের ভাষা ঠিক রেখে সময়টা র‌্যাবের ক্রসফায়ার শুরুর দিন থেকে কার্যকর করতে হবে। একটা কাজ করার পর দায়মুক্তি দেওয়া থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে এখন একবারে নতুন আইনের কার্যকারিতা ৪ জানুয়ারি ২০১৪ অর্থাৎ বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত করে ফেললেই একবারে লেঠা চুকে যায়। এই নতুন দায়মুক্তি আইনটার কার্যকারিতা গত বিএনপি সরকারের সময় থেকেই অর্থাৎ র‌্যাব সৃষ্টির সময় থেকে হতে হবে। তাহলে সর্বদলীয় সমর্থন পাওয়া যাবে। ১৯৭৫-এর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো এর অপমৃত্যু হবে না। দুই দল মিলে এই দায়মুক্তি আইনটাকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ঢুকিয়ে দিলে ব্যবস্থাটা আরও পাকাপোক্ত হবে।


২০০২-এর শেষে তৎকালীন নতুন বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রথম ভাগে যৌথ বাহিনীর হাতে ধৃত বহু ব্যক্তির অকাতরে ‘হার্ট-অ্যাটাক’ হয়। তারপর র‌্যাব ও ক্রসফায়ার।
প্রথম প্রথম যখন লিখলাম, তখন অনেক পরিচিতজনই মহাক্ষাপ্পা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীরা যখন ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া শুরু হলো, তখন কোনো কোনো জায়গায় মিষ্টি বিতরণও হয়েছিল। ভালো।
চরমপন্থী থেকে সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী থেকে এখন ঠেকেছে ‘গাড়ি চুরির সংঘবদ্ধ’ দলের সদস্যতে।
বাড়ির মা-নারী-বোনেরা সবে লাঠিপেটা খেতে শুরু করেছে। এক সপ্তাহে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অথবা পুলিশের হেফাজতে মারা যাওয়া তিন ব্যক্তির অন্তত একজনের বিরুদ্ধে কোনো থানায় নাকি জিডিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী থেকে জিডি-মামলাবিহীন বন্দুকযুদ্ধকারী—এটা অবধারিত পথপরিক্রমা। আগে ছিল যৌথ বাহিনী, তারপর র‌্যাব, আর এখন পুলিশও সমভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আনসার-ভিডিপি আর কত দিন বসে থাকবে।
গ্রেপ্তার করে ‘ক্রসফায়ার’-এ না দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা আজকাল প্রায়ই সংবাদপত্রে আসছে। সম্প্রতি নিহত মিজানের স্ত্রী বলছেন, তিনি দুই হাজার টাকা নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। চাহিদা ছিল এক লাখ টাকা। ফলাফল, মিজান গভীর রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ, পরে হাসপাতালে মৃত্যু। লাশটা তো নদীতে ভেসে ওঠেনি বা কোনো গর্তে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে সরকারি হাসপাতালে।
পাঠককুল! বেয়াদবি মাফ করবেন, সেই আশা-ভরসায় আপনাদেরও একটু উপদেশ দিই। অবশ্য এটা ‘আইনি উপদেশ’ না, বাস্তবতাপ্রসূত। সাধ্যমতো ঘরে অন্তত ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ রাখবেন। সঙ্গে স্ত্রীর একজোড়া পুরু সোনার বালা থাকলে আরও ভালো। কুল্লে দুই হাজার টাকা দিয়ে যে কোনো ফায়দা হবে না, অন্তত সেটা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার।


আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য সরকার মাসখানেক আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই করেছে। এখনো সম্পূর্ণভাবে না হলেও অচিরেই এই আদালতের আমরা এখতিয়ারভুক্ত হব।
সাদামাটা কথায়, কোনো দেশে যখন কিছু লোক সেই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যায় অর্থাৎ হয় সেই দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা ওই সব লোককে আইনের আওতায় আনতে বা বিচার করতে পারে না অথবা বিচার করতে চায় না, তখনই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার কার্যকর হয়।
৩ জুলাই প্রথম আলো খবর ছেপেছে যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও অধিকারের হিসাব অনুায়ী গত ছয় মাসে ৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। স্পষ্টতই আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অক্ষম অথবা অনিচ্ছুক।
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত হিসাব জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই রাখা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত জাতিসংঘের হিসাবরক্ষক (রেপোর্টিয়ার) বেশ কিছুকাল ধরে বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করছেন। হাজার হলেও জাহিসংঘের কর্তাগোছের ব্যক্তি, তাই সরকারি নেমন্তন্ন ছাড়া আসতে পারেন না। সেই উট পাখির মতো বালুতে মাথা ঢুকিয়ে রেখে কেউ আমাকে দেখছে না ভাবা যেমন ভুল, তেমনি ভুল করছেন এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আদেশ-নির্দেশ দেওয়া এবং তাঁদের হুকুম তামিল করা ব্যক্তিবর্গ এবং ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা’।


লিখছি আর ভাবছি, আমার অবস্থানটি সেই গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের পাশে গরু চড়ানো রাখাল বালকটির মতো কি না। ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে’ বলে অতিরঞ্জিত ভয় বা মিথ্যাচার করছি না। কিন্তু সেই গল্পেও তো বাঘটা একদিন ঠিকই এসেছিল।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকারী বাঘ শুধু রাখাল বালকটিকে খেয়ে ক্ষান্ত হয় না; আস্তে আস্তে প্রথমে ডজন, তারপর শত শত (আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছি), তারপর হাজার হাজার এবং শেষতক, ব্যর্থ রাষ্ট্র।
পাকিস্তান, ইয়েমেন, সুদান, কসোভো, সার্বিয়া, কিরগিজস্তান, জর্জিয়া—সব রাষ্ট্রেই বর্তমান অবস্থার শুরু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে। রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, সিয়েরা লিওন—সব দেশের কেচ্ছা শুরু একটা বাক্য থেকেই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে গড়পড়তা—আমার মুদ্রাদোষের ‘বড়দাগে’ সময় লেগেছে এক দশক বা তারও কম।
শাহদীন মালিক: আইনজীবী-সুপ্রিম কোর্ট, ডাইরেক্টর-স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.