মণিপুরি রাসমেলা -উত্সব by আকমল হোসেন নিপু

কার্তিকের হালকা কুয়াশামোড়া ভোর। সেই কুয়াশার চাদর সরিয়ে ভোরের আলো ফোটামাত্রই অন্য এক দিন, অন্য রকম কোলাহল, হইচই। নিভৃত পল্লীর শান্ত পরিবেশে যা সম্পূর্ণ আলাদা। নানা বয়সের শত শত মানুষ, হাজার হাজার মানুষ একটি স্থির গন্তব্যের দিকে ছুটছেন। ধুলো ওড়া বাতাসে ভাসছে মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসরঘণ্টা, বাঁশির সুরতরঙ্গ। সম্পূর্ণ নতুন সাজে প্রাণচঞ্চল পুরো এলাকা।
আর দিন শেষে রোদের রং মুছে গেলেই গাছের পাতায়, ধানের শীষে, খোলা মাঠে, ঘরের চালে লুটিয়ে পড়বে রাসপূর্ণিমার মন আলাভোলা করা আলো। সেই জোছনায় ভাসবে গ্রাম, ভাসবে মানুষ...। যেন এই একটা দিন, একটা রাত্তিরের জন্যই উত্সবপ্রাণ মানুষের অপেক্ষা ছিল, পথচেয়ে কেটেছে সারা বছর।
মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় মহোত্সব শ্রীশ্রীমহারাসলীলা এলে এ রকমই একটি দৃশ্য, উত্সবের চেনা হাট। এ বছরও এই উত্সব নিয়ে প্রস্তুত সব আয়োজন। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর এলাকায় এখন উত্সবের উত্তেজনা। মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজার জোড়ামাণ্ডপে ২ নভেম্বর ২০০৯ সোমবার উদ্যাপন করা হবে ১৬৭তম শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ মহোত্সব। জানা গেছে, মাধবপুর জোড়ামাণ্ডপের রাসলীলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়। অন্যদিকে উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের আদমপুরে রাসমেলার আয়োজন করে মণিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায়। দুই জায়গাতে আয়োজন হলেও উত্সবের মর্মবাণী সেই একই। আয়োজকেরা জানালেন, রাসলীলার মূল বাণীতে রয়েছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্য সুন্দর মানবপ্রেমের কথা।
রাসলীলা উদ্যাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেছিলেন। আর মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের এই মাধবপুরেই প্রথম শুরু হয়েছিল রাসমেলা। সেই ধারাবাহিকতায় শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ মহোত্সব মাধবপুরেরই শুধু নয়, উত্সব-পার্বণ হিসেবে মৌলভীবাজারের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, জগত্পতি কৃষ্ণের ১২ ধরনের রস থেকেই এই রাস শব্দের উত্পত্তি। আর এই রাসের সঙ্গে মেলা যুক্ত হয়ে ‘রাসমেলা’। এই ১২টি রসের মধ্যে আবার সাতটি রস হচ্ছে গৌণ। আর পাঁচটি রস হচ্ছে মুখ্য। এই পাঁচটি রসের মধ্যে আবার তিনটি রস হচ্ছে প্রধান। এগুলো হচ্ছে সখ্য, বাত্সল্য ও মধুর। এই তিন রসের উপস্থাপন করা হয়ে থাকে রাসলীলায়।
আয়োজকেরা জানান, রাসমেলার দিন সকালে মাধবপুর জোড়ামাণ্ডপ প্রাঙ্গণে শুরু হবে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য’— গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বালকবেলার রাখাল সাজে মণিপুরি শিশুরা নৃত্য করবে। কলাগাছের তৈরি কুঞ্জে গোষ্ঠলীলায় পরিবেশন করা হয় কৃষ্ণের সখ্য ও বাত্সল্য রসের বর্ণনা। গোধূলি পর্যন্ত এই রাখাল নৃত্য চলতে থাকবে। রাতের বেলা চলে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। মূলত গভীর রাতে শুরু হয় রাসনৃত্য। ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত টানা এই রাসনৃত্য চলতে থাকে। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুর লীলাই গানে-সুরে-কথায় প্রকাশিত হয়। তখন জোড়ামাণ্ডপ ঘিরে থাকেন কৃষ্ণভক্তরা। মাঝেমধ্যে মানসের হরিলুট (কলা, বাতাসা ছুড়ে দেওয়া হয়) চলে। অনেকেরই নানা রকম মানস থাকে। হরিলুটের প্রসাদ কুড়ানোর আছে অন্য রকম আনন্দ। গোষ্ঠলীলা ও রাসনৃত্যের ফাঁকে ফাঁকে দিনব্যাপী চলে অন্যান্য অনুষ্ঠানও।
জানা গেছে, রাসপূর্ণিমায় এই জোড়ামাণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে আছে বেশ কাড়াকাড়ি। যাঁরাই জোড়ামাণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব পান, তাঁরা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেন। নিয়ম অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে একেক বছর একেক ‘শিংলুপ’ (পুঞ্জি বা গোষ্ঠী) এই দায়িত্ব পেয়ে থাকে। এই শিংলুপের মধ্যে আবার পর্যায়ক্রমে কন্যাসন্তান আছে, এমন পরিবারের ওপর দায়িত্ব পড়ে থাকে। আনন্দের সঙ্গে সেই পরিবার মণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব পালন করে থাকে। তবে এই দায়িত্ব নিতে অনেকেই আগ্রহী। অনেক সময় শিংলুপের মধ্যে কে দায়িত্ব নেবেন, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ লেগে যায়। তখন মহারাসলীলা উদ্যাপন কমিটি নিজেদের ক্ষমতাবলে দায়িত্ব বণ্টন করে থাকে। যাঁরা আগে দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁদের বাদ দিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেন। জানা গেছে, গোষ্ঠলীলা ও রাসনৃত্যের মহড়া এরই মাঝে শেষ হয়েছে। রাসপূর্ণিমা আসছে, এই বার্তাতেই নড়ে উঠেছে এলাকা। মাধবপুর জোড়ামাণ্ডপে রাসমেলার আয়োজক মণিপুরি মহারাসলীলা সেবাসংঘের সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্রকুমার সিংহ জানালেন, সুন্দরভাবে রাসমেলা সম্পন্ন করতে সকল আয়োজনই সম্পন্ন করা হয়েছে। গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলার বাইরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে।
অপরদিকে ১৯৮৬ সাল থেকে আদমপুরে মণিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায় রাসমেলার আয়োজন করে আসছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এর আগে শুধু মাধবপুরেই রাসমেলা হতো। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ এই দ্বন্দ্বে ভাগ হয়ে যায় মাধবপুরের রাসমেলা। মাধবপুর শিববাড়ির জোড়ামাণ্ডপে রাসমেলার যেমন ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি এখন আদমপুরের রাসমেলাও নিজস্ব একটা আদল তৈরি করে নিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। আদমপুরে গোষ্ঠলীলা ও রাসনৃত্যের পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয় মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাসমেলাকে ঘিরে ভানুগাছ-ধলই এবং উপজেলা-আদমপুর সড়ক ছোট-বড় শত শত গাড়ির আসা-যাওয়ায় ব্যস্ত থাকে এই একটি দিন। অনুষ্ঠানস্থলের অনেক আগেই জটে পড়ে থেমে যায় গাড়ির চাকা। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাসমেলা এখন আর শুধু মণিপুরি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উত্সবই থাকেনি। জাতপাত, ধর্ম-বর্ণের বাইরে উত্সবে এসে মানুষের কাতারে একাকার হয়ে যায় সবাই।
রাসমেলাকে কেন্দ্র করে মাধবপুর ও আদমপুর দুটি স্থানেই বসে শত শত রকমারি পণ্যের দোকান। মণিপুরি তাঁতের তৈরি পোশাক, কুটির শিল্প, নানা রকম তৈজসপত্র, শিশুর খেলনা, চুড়ি কিংবা খোঁপার ফুল—কী নেই রাসমেলায়। আছে খৈ-মুড়ির মোয়া, নানা রকমের খাবার, ফুলকপির বড়া। আর নির্বিরোধ ভিড় তো আছেই। সবাই হইহই করে এদিক-ওদিক ছুটছে। সারা বছরে জমিয়ে তোলা এই একটা দিন—যেন অকারণে ফুরিয়ে না যায়, এই তাড়া সবার মধ্যে। ষোলো আনা আনন্দ চাই ঘরে ফেরার আগে। যে আনন্দের নিঃসরণ চলবে সারাটা বছর ধরেই।

No comments

Powered by Blogger.