সংবিধান কমিশন যে কারণে জরুরি -সরকারের মেয়াদ by এ কে এম জাকারিয়া

নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বিরোধী পক্ষের সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর রেওয়াজ নব্বইয়ের পরবর্তী সবগুলো সরকারের আমলেই আমরা দেখেছি। এবার অবশ্য এখনো ঘোষণা দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়নি। তবে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অব্যাহত আছে। সংসদীয় কমিটিগুলো কাজ করছে, সংসদ বসছে, আলোচনা হচ্ছে—এসব যুক্তি যতই দেওয়া হোক, বিরোধী দল ছাড়া সংসদ কোনোভাবেই কার্যকর বলা যায় না। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর, বর্তমান সরকার সে সময় পর্যন্তই ক্ষমতায় থাকবে ধরে নেওয়া যায়। আমরা সবাই সেটা চাই। গত তিনটি সরকারের মেয়াদপূর্তি আমাদের সেই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু সংসদ ও সরকার তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করলেও সংসদ কার্যকর থাকবে, সে ভরসা আমরা করতে পারছি না।
বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি হতে আরও মাস দুয়েক বাকি। অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা হচ্ছে, কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে একপর্যায়ে বিরোধী দলের সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক ও সংসদ বর্জন—এসবের মধ্য দিয়েই বাকি চার বছর দুই মাস সময় কাটবে। তবে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের মেয়াদ কমানোর যে প্রস্তাব রেখেছেন, তা কার্যকর করা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, সংসদ ও স্থানীয় সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদের বিষয়টি বেশ লম্বা, তাই তা কমানো উচিত। স্থানীয় সরকারের মেয়াদ তিন বছর হওয়া উচিত বলে তিনি মত দিয়েছেন। তবে সংসদের মেয়াদ কত হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব রাখেননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করলে তাঁর এই প্রস্তাবকে যৌক্তিক মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
গত তিনটি নির্বাচিত সরকারের সময়ে সরকার পতনের আন্দোলন এবং এর নামে ঘেরাও, হরতাল, অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াও—সবই হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কোনো সরকার পতনের ঘটনা ঘটেনি। এর কারণ এটা নয় যে জনগণ সরকার ও তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিল। সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্টি নিয়েও জনগণ এটা মেনে নিয়েছে যে সরকার নির্বাচিত হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য, এই সময়ে খারাপ ভালো যাই করুক, তারাই ক্ষমতায় থাকুক। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে ক্ষমতার পরিবর্তন হোক, এটা সাধারণভাবে জনগণ গ্রহণ করেনি। তাই বিরোধী পক্ষের সরকার পতনের আন্দোলন বা ডাক সফল হয়নি। জনগণ ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, সেখানে তারা তাদের কাজটি করেছে। জনগণ যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক অবস্থান নিয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল তার বড় প্রমাণ। কিন্তু জনগণকে এ জন্য পাঁচ বছরের ধৈর্য আর সহনশীলতার পরীক্ষা দিতে হয়। একদিকে হয়তো তারা সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের সরকার পতনের আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও মেনে নিতে পারে না। সরকার বা সংসদের মেয়াদ কমলে এই দিক থেকে জনগণের ওপর চাপ কিছু কমবে বলে মনে হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাজ্যে হাউজ অব কমন্সের সর্বোচ্চ মেয়াদ পাঁচ বছর। কিন্তু কার্যকর মেয়াদ চার বছর। সরকারের মেয়াদ চার বছর পুরো হলেই নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের মেয়াদ চার বছর। গণতন্ত্র আর বেশি মেয়াদের সরকার — এই দুটি আসলে একসঙ্গে যায় না। তুরস্কে পার্লামেন্টের মেয়াদ কমানো হয়েছে ২০০৭ সালে। গণভোটের মাধ্যমে সেখানকার জনগণ পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছরের যায়গায় চার বছর করেছে। ভারতে অবশ্য লোকসভার মেয়াদ পাঁচ বছর। ভারতকে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় নিই। সেখানে যদি চলতে পারে, তবে আমাদের এখানে কেন মেয়াদ কমানোর দরকার পড়ল, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতে পারে। এর একটি সাধারণ জবাব হচ্ছে, যুক্তরাজ্য বা ভারতে নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় না, আমাদের মতো অকার্যকর সংসদ নিয়ে সরকারকে পুরো মেয়াদ কাটাতে হয় না। এর চাইতেও বড় কথা, দেশ দুটিতে আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কঠোর কোনো অনুচ্ছেদ নেই—‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যাক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য বলিয়া গণ্য হইবে।’ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন আইন ১৯৯১(১৯৯১ সালের ২৮ নং আইন)-এর ৫ ধারা বলে এই বিধান কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার চরম স্বেচ্ছাচারী কোনো আচরণ করলেও আমাদের সংবিধান সরকারের পতন ঘটানোর মতো কোনো ক্ষমতা সাংসদদের দেয়নি। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতে পারলেই পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা নিশ্চিত। ভারতের বর্তমান সংবিধান এককভাবে পার্লামেন্টের কোনো সদস্যকে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান বা ভোট দেওয়ার ক্ষমতা না দিলেও সমষ্টিগতভাবে দিয়েছে। দলের সদস্যদের একটি গ্রুপ প্রয়োজনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবে। ১৯৮৫ সালে ভারতীয় সংবিধানের এই ৫২তম সংশোধনীর আগে পার্লামেন্টের সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারতেন। দীর্ঘ সময়ে এই গণতান্ত্রিক চর্চার পর তারা এই সংশোধনী এনেছে। ভারতের সংবিধান শুরুতে এককভাবে এবং পরে সমষ্টিগতভাবে পার্লামেন্টের সদস্যদের দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের কোনো স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে অবস্থান খোলা রয়েছে। জওহরলাল নেহরুর পর ভারতে প্রথমবারের মতো গত মনমোহন সিংয়ের সরকার ক্ষমতার পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। গত ৪০ বছরে ভারতে কোনো সরকার পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি দলের সদস্যদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় ভারতের সরকারগুলো হয়তো এক অর্থে স্থিতিশীল ছিল না। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নানা কারণে সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু এই চর্চা সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করলেও দেশটির গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করেছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে দলের প্রধান দলের মধ্যে একক ক্ষমতা ভোগ করেন, বিরোধী দলের কারণে-অকারণে সংসদ বর্জনের ফলে সংসদ যেখানে অকার্যকর, সংবিধান যেখানে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত সাংসদকে দলের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দেয়নি, সংবিধান বরং প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত ক্ষমতা নিশ্চিত করেছে ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে’ বাক্যটির দ্বারা, তখন পাঁচ বছর মেয়াদের একটি সরকার মানে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সরকারকে কার্যত পাঁচ বছরের জন্য যা ইচ্ছা, তা করার স্বাধীনতা দেওয়া। অন্তত বিগত জোট সরকারের কাজে-কর্মে এর প্রমাণ মিলেছে। সরকারের মেয়াদ কম হলে, ধরা যাক যদি চার বছর হয়, তবে জনগণ সরকারকে অন্তত এক বছর আগে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। আর বিরোধী পক্ষের সরকার পতনের আন্দোলনের মেয়াদও তখন বছরখানেক কমবে।
সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক সংসদের মেয়াদ কমানোসহ আরও কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখায় আমরা ধরে নিতে পারি, এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই দলের মধ্যে জোরালো চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। আবার সরকারি দল থেকে এ ধরনের প্রস্তাব আসায় বিরোধী পক্ষ তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখবে—আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই স্বাভাবিক। অনেকের ব্যাখ্যা, সরকার অজনপ্রিয় হওয়ার আগেই নির্বাচন দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়। তাই সরকারের মেয়াদ কমানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা মানতে হবে, আমাদের সংবিধান হয়েছে ১৯৭২ সালে। এর পর প্রায় ৩৭ বছর পার হয়ে গেছে। সংবিধানে এর মধ্যে নানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সংবিধান বা শাসনতান্ত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি পর্যালোচনা করে পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার। একতরফাভাবে কিছু করার চেয়ে সরকারের উচিত, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংবিধান পর্যালোচনা কমিশন গঠন করা। যাঁরা সংবিধানের নানা দিক পর্যালোচনা করে এর ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত ও প্রয়োজনয়ীয় সংশোধনের প্রস্তাব দেবেন। ভারতে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ ধরনের কমিশন গঠন করা হয়েছিল (Constitution Review Commission)। যাদের ওপর গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় কার্যকর সুশাসন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক ভারতের জন্য সংবিধানে কী পরিবর্তন আনা উচিত, সে ব্যাপারে মতামত ও প্রস্তাব দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি বি পি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বে ১০ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে ২০০২ সালের ৩১ মার্চ সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রীও সংবিধান সংশোধনে সরকারের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। সংসদ ও সরকার বা স্থানীয় সরকারের মেয়াদ কমানো, কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভবিষ্যত্—বিষয়গুলো পর্যালোচনায় নিয়ে আমাদের দেশে এ ধরনের একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। ভারতের সংবিধান পর্যালোচনা কমিশন বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা বিতর্ককে উত্সাহিত করেছে। একই ধরনের কিছু এখানেও শুরু করা যায়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.