দেড় মাসে বিএনপির ৫০০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার মুক্তি মিলছে না by কাফি কামাল

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেড় মাসে দলটির ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কয়েকশ’ নতুন মামলার     পাশাপাশি গ্রেপ্তারকৃতদের নাম যুক্ত হচ্ছে পুরনো পেন্ডিং মামলায়।
খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের পর বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। প্রতিদিন যে পরিমাণ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেভাবে মিলছে না তাদের জামিন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার সিনিয়র নেতারা কেউই মুক্তি পাননি। নিম্ন আদালতে মামলার তারিখ পড়ছে লম্বা সময় নিয়ে। যে কারণে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫ বছরের সাজার রায় দেয় ৮ই ফেব্রুয়ারি। ওইদিনই তাকে পাঠানো হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ৩০শে জানুয়ারি রাতে গুলশান শুটিং ক্লাবের সামনে থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় আদালত। তারপর থেকেই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন তিনি। নিম্ন আদালতে তার পরবর্তী হাজিরার দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ১২ ও ১৩ই মার্চ। দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিক নানা অসুখে ভুগছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। তার দুই ছেলের একজন অনিন্দ ইসলাম অমিত বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক। অন্যজন শান্তনু ইসলাম সুমিত রাজনীতিতে সক্রিয় নন। ৩০শে জানুয়ারি শান্তিনগরের বাসা থেকে অমিতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন রাতে ডিবি কার্যালয়ে ছোটভাই অমিতের জন্য ওষুধ ও গরম কাপড় নিয়ে গেলে সেখান থেকে তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তারপর থেকেই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন তারা। তাদের মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে আগামী ১৩ ও ১৪ই মার্চ। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও কেন্দ্রীয় নেতা নাজিমউদ্দিন আলমকে মহাখালীর বাসভবন থেকে ২রা ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে আমান উল্লাহ আমান কাশিমপুর কারাগার-২ ও নাজিমউদ্দিন আলম কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে রয়েছেন। নাজিমউদ্দিন আলমের ব্যক্তিগত সহকারী বিপ্লব জানান, নিম্ন আদালত থেকে তাদের মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ১১ই মার্চ। তিনি জানান, আগে পুটআপ দিয়ে সপ্তাহ পর পর জামিন চাওয়া যেতো। এখন ধার্যকৃত দিন ছাড়া জামিন চাওয়া যায় না। এমনকি জামিনের দিনও এগিয়ে আনা যায় না।
ওদিকে বিএনপির কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচির দিন ২৪শে ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে দুজনই রয়েছেন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। তাদের পারিবারিক সূত্র জানায়, নিম্ন আদালত সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ২৭শে মার্চ ও মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের ২৪শে মার্চ হাজিরার দিন ধার্য করেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার পর বকশীবাজার বিশেষ আদালত প্রাঙ্গণ থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে ও নয়াপল্টন থেকে ছাত্রদল সভাপতি রাজীব আহসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন চট্টগ্রামে দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর গ্রেপ্তার হন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। চারজনকেই একাধিকবার রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলেও মিলছে না জামিন। হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেয়ার পর নির্ধারিত সময়ে সোমবার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মো. মুনির হোসেন। ৬ মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট।
১২ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে ফেরার পথে মৎস্য ভবনের সামনে থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুকে, ৬ই মার্চ মানববন্ধন শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বর থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও ৮ই মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমান রাজকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ২রা ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মোতালেব হোসেন, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান মাসুক, নড়াইলে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি জুলফিকার আলী, ৬ই ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি সভাপতি শাহ আলম, জেলা যুবদল সভাপতি সাইফুল ইসলাম শাকিল ও জেলা যুবদল সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস, পাবনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান তোতা, ৫ই ফেব্রুয়ারি শেরপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হজরত আলী, ৮ই ফেব্রুয়ারি বরগুনা জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক তারিকুজ্জামান টিটু, ৯ই ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়াহাব আকন্দ, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টুটুল, ১০ই ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুন মাহমুদ, ১১ই ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আহসানুল করিম হিটু, ১৩ই ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলা বিএনপি সভাপতি রহমতুল্লাহ পলাশ, ১৮ই ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এমএ শামীমসহ সারা দেশে ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যারা এখন দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
বিরোধী নেতাকর্মীদের জামিনপ্রক্রিয়া বিলম্বের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, রাজনৈতিক মামলাগুলোতে সাধারণত কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে না। তাই নিম্ন আদালতেই সহজে তাদের জামিন পাওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে মামলায় লম্বা ডেট দেয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীরা যেন সহজে জামিন না পান। বিরোধী নেতাকর্মীদের ডিফারেন্ট ডিভাইসে মামলায় লম্বা ডেট দিয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, বিগত দুই মাস ধরে নিম্ন আদালতে নতুন ধরনের প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে। নিম্ন আদালত জামিন দিচ্ছে না, রিমান্ডে দিচ্ছে। আবার জামিনের আবেদনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিও করছে না। লম্বা লম্বা তারিখ দেয়ার মাধ্যমে জামিনের জন্য হাইকোর্টে যাওয়ার পথ প্রলম্বিত করছে। গত ২০-৩০ বছরে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। ব্যারিস্টার খোকন বলেন, সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে গ্রেপ্তারকৃত বিরোধী নেতাকর্মীদের ডিটেনশন দিচ্ছে না। কিন্তু জামিনপ্রক্রিয়া প্রলম্বিত করার মাধ্যমে ‘আন ল ফুল’ ডিটেনশন দিচ্ছে। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, নিম্ন আদালত হয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনের জন্য আবেদন করতে সাধারণত সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় লাগে। কিন্তু এখন নিম্ন আদালতেই দিন ধার্য করা হচ্ছে এক থেকে দেড় মাস পর। তিনি বলেন, এক সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে ডিটেনশনের মাধ্যমে রাজনীতিকদের কারাগারে আটকে রাখা হতো। এখন ডিটেনশনের আনুষ্ঠানিকতা নেই তবে পেন্ডিং বা নতুন মামলা দিয়ে কৌশলে ডিটেনশনের মতোই আটকে রাখা হচ্ছে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে সরকার। তাদের এমন বিহেভিয়ারের পেছনের অ্যাটিচুড তা হচ্ছে বিরোধী নেতাদের আটকে রাখা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রতিটি কর্মসূচি থেকেই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। বিশেষ করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তারের পর পুরনো জটিল মামলাগুলোতে নাম যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। ফলে ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীরা সহজে জামিন পাচ্ছেন না, তাদের জামিনে বিলম্ব হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.