রিকশা বাণিজ্য: রাজধানীতে অবৈধ ১০ লাখ, বৈধ ৮৭ হাজার by হাফিজ মুহাম্মদ

রাস্তায় প্রতিদিনই যানজট। এর পেছনে বিরাট ভূমিকা পালন করে রিকশা। গলিপথ থেকে মূল সড়ক সর্বত্র রিকশার দাপট। আর এই রিকশা চলছে একাধিক অসাধু চক্রের নিয়ন্ত্রণে। এ রিকশা সিন্ডিকেট চক্রের সংখ্যা নামে-বেনামে কমপক্ষে ৩০টি। তারা দিয়ে থাকে নম্বর প্লেটও। বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা চলে যায় তাদের পকেটে। অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের হিসেবে রাজধানীতে বৈধ রিকশা রয়েছে ৮৭,৮১১টি। যার মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিবন্ধিত ৫৮,৯৮১টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮,৮৩০টি। এগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ৩১ বছর আগে। ১৯৮৭ সালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দিয়েছিল। এরপরে বেশ ক’বার অবৈধ রিকশাগুলোকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার কথা থাকলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সিটি করপোরেশন বলছে তারা রিকশার নতুন নিবন্ধন নয় বরং তাদের নিরুৎসাহিতই করছেন। রিকশা মালিকপক্ষ জানিয়েছে, তারা সিটি করপোরেশনের কাছে পুরাতন রিকশার নবায়ন ও নতুন রিকশার বৈধতা চেয়েও পাচ্ছেন না। তাদের কথায় সিটি করপোরেশন কোনো কর্ণপাতই  করে না। কর্তৃপক্ষ অনুমতি না দেয়ায় শ্রমিক সংগঠনের নম্বর প্লেট সংগ্রহ করে তারা রাস্তায় রিকশা নামান। এসব সংগঠন ট্রাফিক থেকে সব মহল ম্যানেজ করে থাকেন। বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়। তিন মাস পরে নির্দিষ্ট সংখ্যক চাঁদা এবং বছর শেষে একবার ফি দিয়ে নবায়নও করে নিতে হয়। সিটি করপোরেশন বৈধতা দিলে রিকশা মালিকরা চক্রের আশ্রয় নিতেন না বলেও জানান। বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল  বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ৮৫ হাজারের অধিক। এর বিপরীতে অনিবন্ধিত রিকশা রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ। সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন না পেয়ে এসব রিকশা চলছে সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে। এসব চক্রের সঙ্গে আঁতাত করেই মালিকদের রাস্তায় রিকশা নামাতে হচ্ছে। আর এসব সিন্ডিকেট চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে প্রধানত বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগ। এর বাহিরে রয়েছে বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ রিকশা মালিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। তারা নিজেদের একে অপরকে শ্রম অধিদপ্তরের বৈধ সংগঠন দাবি করে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন নামে চাঁদা আদায়ের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। তারা নিজেরাই নিজেদের নম্বর দেয়া রিকশা ভ্যানের সংখ্যা বলতে পারছে না। বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনের অধীনে কতগুলো রিকশা আছে তার সঠিক সংখ্যা জানে না চক্রও। তারা শুধু রিকশা নামান আর টাকা তুলেন। কোনো কোনো সংগঠন নিজেদের কাছে সংখ্যা দিয়ে টাকা উঠালেও তাদের রিকশার তালিকা দেখাতে পারছেন না।
বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী বলেন, ২০০১ সালে অবিভক্ত সিটি করপোরেশন আমাদেরকে ৩৫ হাজার রিকশা এবং ৮ হাজার ভ্যান নিবন্ধন দেয়ার একটা চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার নিবন্ধন দেয়া হয়নি। ঢাকা সিটিতে আমাদের সংগঠনের নম্বর প্লেট নিয়ে ৪৩ হাজার রিকশা-ভ্যান রাস্তায় চলছে। এগুলোর নবায়ন ফি হিসেবে প্রতিবছর ৩০০ টাকা হারে সদস্যদের কাছে জমা রয়েছে। তারা সরকারকে রাজস্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত। আমাদের সদস্যদের কাছে ১৬ কোটি টাকা রাজস্ব জমা আছে। কিন্তু সরকার এবং সিটি করপোরেশন এটার কোনো সুরাহা করছে না। এর বাহিরে প্রতি তিন মাসের জন্য রিকশা প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা নিয়ে থাকি। যা শ্রম অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে আসি। এ শ্রমিক নেতা আরো বলেন, আমাদের বাহিরে আরো মুক্তিযোদ্ধা নামদারি একাধিক সংগঠন রয়েছে যাদের কোনো প্রকার অনুমতি নেই। তারা প্রতিনিয়ত মালিকদের মাধ্যমে রিকশা নামাচ্ছে। এদের প্রায় ২ লাখের উপরে রিকশা রয়েছে। সর্বশেষ একটা চক্র বের হয়েছে ব্যাটারি চালিত রিকশার। তাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেও কোনো লাভ হয়নি। সরকার যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশা-ভ্যান নিবন্ধন করতো তাহলে অবৈধ রিকশা বন্ধের ফলে নগরীতে যানজট অনেকাংশে কমে যেত।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্র বড়ুয়া বলেন, সর্বশেষ আমরা উত্তরের বৈধ রিকশাগুলোকে পাঁচ বছরের জন্য অনুমতি দিয়েছিলাম। এজন্য তাদের নিবন্ধনকৃত নম্বর প্লেট দেয়া হয়েছিল। যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে আবার তাদের পাঁচ বছরের জন্য অনুমতি দেয়া হবে। তাদের নতুন নম্বর প্লেট দেয়া হবে। যার একটি চালান ইতিমধ্যে চলে আসছে। এ ছাড়াও উত্তর সিটি করপোরেশনের অবৈধ রিকশা বন্ধে কয়েকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (ট্রাফিক) সমন্বয়ে এসব রিকশা বন্ধে সর্বদা অভিযান চলছে বলেও তিনি জানান। উত্তর সিটি করপোরেশনের এ রাজস্ব কর্মকর্তা আরো বলেন, রাজধানীর যানজট কমাতে রিকশাকে তারা নিরুৎসাহিত করছেন। নগরীর সীমানা বৃদ্ধির এলাকাগুলোর রিকশাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে কিনা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, এটা একটা বড় প্রজেক্ট। সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকারই এটা বলতে পারবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার বলেন, আমাদের নিবন্ধনকৃত রিকশাগুলোই প্রতি পাঁচ বছর পরে নবায়ন করছি। সিটির অনিবন্ধনকৃত রিকশা নিবন্ধনে কর্তৃপক্ষের আপাতত চিন্তাভাবনা নেই। বিভিন্ন মালিক সংগঠন এভাবে অবৈধভাবে রিকশা চালালেও আমরা কিছু করতে পারছি না। এসব অবৈধ রিকশা শ্রমিক সংগঠন আপনাদের তো রাজস্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে আপনারা তা কেন নিচ্ছেন না জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির এ রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, তাদের রিকশাগুলোর বৈধতা দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে আমরা কিভাবে রাজস্ব গ্রহণ করবো। রাজধানীতে অবৈধ রিকশার মাধ্যমে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। তবে তাদের এ ব্যাপারে তেমন কিছু করার নইে বলে জানিয়েছেন। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, ঢাকা শহরে মানুষ বিকল্প গণপরিবহন পর্যাপ্ত পাচ্ছে না বলেই রিকশার সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। রিকশা ভাড়া তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি তারপরও সাধারণ মানুষকে এটাকেই বেছে নিতে হচ্ছে। আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলের যানবাহন নিয়ে চিন্তাভাবনা নেই। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে এসব রাস্তায় চলাচলকারী মানুষকে। শুরু থেকে যদি রিকশার নিবন্ধন এবং নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে দেয়া হতো তাহলে এমন অবৈধ রিকশার সংখ্যা বাড়তো না।

No comments

Powered by Blogger.