অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুধু কথার কথা নয় by ইকতেদার আহমেদ

পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রে বিচার বিভাগকে বলা হয় জনগণের শেষ ভরসাস্থল। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অন্যতম একটি। অপর দুটি হল আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ। উন্নত ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ তিনটি বিভাগ পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সমঝোতার ভিত্তিতে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে। বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল নামে অভিহিত। অ্যাটর্নি জেনারেল পদটি সাংবিধানিক। সাংবিধানিক অপরাপর পদের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল পদের পার্থক্য হল- অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি শপথের অধীন নন এবং এ পদের নির্ধারিত কোনো মেয়াদ নেই।
সুপ্রিমকোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্য এমন কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দান করেন; তবে রাষ্ট্রপতিকে এ নিয়োগ কার্যটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হয়। সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা নির্ধারিত বয়সে পৌঁছা অবধি কর্মে বহাল থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশের সব আদালতে রাষ্ট্রের পক্ষে তার বক্তব্য প্রদানের অধিকার রাখেন। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী তার পদে বহাল থাকেন। রাষ্ট্রপতির এ সন্তুষ্টটি সরকারের প্রধান নির্বাহীর আকাক্সক্ষার মধ্যে আবদ্ধ। সচরাচর দেখা যায়, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটলে অথবা অন্য কোনো কারণে সরকারের পরিবর্তন ঘটলে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় স্বীয় মতাদর্শের ব্যক্তিকে নিয়োগদানে সচেষ্ট থাকে। সরকারের নীতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের আদালতে প্রদত্ত বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে, যদিও তাকে বক্তব্য প্রদানকালীন সংবিধান ও আইন উভয়ের বিধিবিধান যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ না হয় সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আদালতে কাজ করে বিধায় তার বক্তব্যের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের বক্তব্যের পার্থক্য কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতির শপথগ্রহণ-পরবর্তী অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানকালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতসংশ্লিষ্ট কিছু দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন- ‘আমি মনে করি, উচ্চাদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভেতরে একটি বিরাট অংশ ইতিমধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ যে বিষয়টি, তা হল বিশেষ বিশেষ কিছু কোর্ট বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে। বিচারপ্রার্থী অনেকে জেনে গেছেন কোন্ কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলায় জেতা যাবে। এটা তো ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অনেকেই ছুটছেন বিচারপতিদের সন্তান, স্ত্রীদের প্রতি, যারা আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত আছেন এ চিন্তা করে যে, এদের নিয়ে গেলে হয়তো মামলায় জেতা যাবে।’ তিনি আরও বলেন- ‘এমনও দেখা যায়, ৪ বছর আগে দায়ের করা মামলা লিস্টে বহাল তবিয়তে আছে, অথচ ২ মাস আগে দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারী মামলা নিচ থেকে উপরে উঠানোর কাজ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। কিছু মামলা শুনানি করা যাচ্ছে না। আবার কিছু মামলার শুনানি হয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে।’ আইনাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও দেশের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে উচ্চাদালতের এ অবস্থা জাতির জন্য ভয়াবহ বিপদের বার্তাবহ। আর তা অনুধাবন করে শুধু কি ফাঁকা মুখে বললেই হল আমরা বীরের জাতি, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি? উচ্চ আদালতে যে কোনো ধরনের মামলা দায়ের, হলফনামা প্রদান, মামলার পক্ষগণের প্রতি নোটিশ প্রদান, মামলার রায় ও আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে নির্ধারিত ফি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত ১০-১০০ গুণ অধিক অর্থ আদায় করে মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দারুণভাবে হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবৎ এসব বিষয় নিয়ে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে এলেও তাদের ক্ষোভ প্রশমনে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে খুব কমই যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সেবা খাতের দুর্নীতিবিষয়ক তাদের প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে অভিহিত করে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ-পরবর্তী সময়ে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে কী ধরনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালককে সুপ্রিমকোর্টে তলব করলে তারা তাদের প্রতিবেদনের পক্ষে তথ্য-উপাত্তসহ দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। টিআইবির অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি যে সঠিক ছিল এ বিষয়ে আদালতের সব ধরনের সংশয় দূরীভূত হয়। উচ্চাদালতে কর্মরত বিচারকদের অনেকের স্ত্রী, কন্যা, কন্যা-জামাতা, পুত্র, পুত্রবধূ, ভ্রাতা তাদের বাসভবনে একসঙ্গে অবস্থান করে উচ্চাদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। দেশের ১৫তম প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন পদে বহাল থাকাকালীন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্টের একটি ফুলকোর্ট সভায় কোনো কর্মরত বিচারক তাদের নিজ গৃহে তাদের সঙ্গে অবস্থান করে এমন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, কন্যা, কন্যা-জামাতা, ভ্রাতার সুপ্রিমকোর্টের আইন পেশায় নিয়োজিত থাকা নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত বিধায় এহেন কাজ থেকে বিরত থাকতে সবিশেষ অনুরোধ করেন। তার সে অনুরোধ যে উপেক্ষিত হয়েছে তা অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বিষয়ে সাম্প্রতিক প্রদত্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত। বিগত দিনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে দু’জন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন সাবেক আইনমন্ত্রী এবং একজন প্রথিতযশা আইনজ্ঞের বক্তব্য অ্যাটর্নি জেনারেলের সাম্প্রতিক প্রদত্ত বক্তব্যে যে হতাশা ও ক্ষোভের চিত্র ব্যক্ত হয়েছে তার চেয়ে ভিন্নতর কিছু নয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে তার এক মন্তব্যে বলেন- ‘এখন বিচার বিভাগ কাচের ঘর, এটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন আইনজীবীদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানকালীন বলেন- ‘বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে।’ উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগ সম্পর্কে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগের সফল আইনমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টে কর্মরত অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন- ‘যাদের কেরানি হওয়ার যোগ্যতা নেই তাদের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ উচ্চাদালতের বিচারক সম্পর্কে দেশবরেণ্য আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মন্তব্য- ‘এখন বিচারকরা মুখ দেখে রায় দেন।’
উপরোক্ত মন্তব্যসমূহে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ব্যক্ত হয়েছে তা অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বিষয়ে প্রদত্ত বক্তব্যের প্রায় এক দশকের অধিক সময় আগে করা হলেও দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সামগ্রিক চিত্রের উন্নীত না হয়ে যে অবনতি ঘটেছে এর সমর্থন তার সাম্প্রতিক প্রদত্ত বক্তব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ধারণী আইনের অনুপস্থিতিতে ২০০১ সাল-পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা- এ চারটি বিষয়ের চেয়ে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন অনেক ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর দলীয় আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার পরিচালনার জন্য স্বীয় শপথ দ্বারা বাধিত হলেও তাদের অনেকে যে সে আবরণ থেকে মুক্ত নন, এর ইঙ্গিত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের ‘বিশেষ বিশেষ কিছু কোর্ট বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে’ এবং ‘কোন্ কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলায় জেতা যাবে’- এর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। বিচার বিভাগ জনগণের শেষ ভরসাস্থল বিধায় একজন বিচারককে শুধু ন্যায়বিচার করলেই হবে না, ন্যায়বিচার দৃশ্যমানও হতে হবে। উচ্চাদালত বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের যে অনুযোগ ও অভিযোগ, তা অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। উভয় আদালতে বিচারকার্য যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয়ে দেশের মানুষ কাক্সিক্ষত মানের ন্যায়বিচার পায় এটি নিশ্চিতে সরকারের পাশাপাশি বিচারক ও আইনজীবী উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। বিচারক ও আইনজীবীরা নিজেদের সম্পূর্ণ দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত রাখলে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক আইনমন্ত্রী ও প্রথিতযশা আইনজীবীর বক্তব্যে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ব্যক্ত হয়েছে এর উত্তরণ ঘটবে। অতীতে অ্যাটর্নি জেনারেলের ন্যায় দেশের চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিচার বিভাগ বিষয়ে রূপক অর্থে প্রায় সমরূপ বক্তব্য দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পরিস্থিতির পরিবর্তন না হয়ে বরং তা ক্রমঅবনতির দিকে গেছে। আর তাই সময় থাকতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে উপরোক্তদের বক্তব্যের অভিযোগ ও অনুযোগ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দীর্ঘদিন তার পদে বহাল থাকবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল তার অভিযোগ ও অনুযোগ বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেছেন। বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট অনেকেই সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত; কিন্তু কতিপয়ের কারণে সামগ্রিকভাবে বিভাগটির মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকে শুধু কথার কথা না ভেবে তা অনুধাবন করে পরিস্থিতির উন্নয়নে সচেষ্ট হলে আশা করা যায় প্রতিকার ও প্রতিবিধান সুদূরপরাহত নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.