সাত মার্চ উদযাপন

বাঙালির মুক্তির সনদ, বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার ঘোষণা- বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে। একে অবলম্বন করে জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে এসেছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ফলে প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসছে সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক দল। তবে এবার সাত মার্চ উদযাপিত হয়েছে একেবারে ভিন্নভাবে। কারণ গত বছরের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণটিকে বিশ্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। এর ফলে আমাদের স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণাটি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের নিপীড়িত জনগণের নৈতিক অধিকার, দাবি ও শোষণমুক্তির অন্যতম সনদ হিসেবে কাজ করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় ভাষণের কোনো নজির আর নেই। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকো। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ভাষণটির সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক দিক হল, এতে বঙ্গবন্ধু এমন কৌশলের আশ্রয় নিলেন যে, এটি একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেল, অন্যদিকে শর্তারোপের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁদে পা দেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’, তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করে তাকে তখনই গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু সেটি তিনি না করায় পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেকদিকে ৪টি শর্তারোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত হল না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
এখানেই সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সার্থকতা। আমরা মনে করি, সাত মার্চের ভাষণ আরও আগেই বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেতে পারত। তবে দেরিতে হলেও এ স্বীকৃতি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো গতকাল রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়েছে ঐতিহাসিক সাত মার্চ দিবস। তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার সত্যিকারের ইতিহাস ও পথপরিক্রমা সম্পর্কে জানানোর জন্য এ ধরনের উদ্যোগ দরকার। অন্যথায় ইতিহাস বিকৃতি ফের আমাদের ঘাড়ে জেঁকে বসতে পারে। সাত মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সোরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্বসম্পত্তিতে পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাঙালি জাতির- একক কোনো দলের নয়। এটি নিশ্চিত করার জন্য উদযাপনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ- ভোটের ও ভাতের অধিকারসহ শোষণহীন জাতি গড়নের শপথও নিতে হবে। তবেই উদযাপন-আয়োজন সার্থক হবে।

No comments

Powered by Blogger.