কিরাত রাজনীতির আবির্ভাব by এবনে গোলাম সামাদ

মঙ্গোলীয় মানবধারার মানুষকে প্রাচীন যুগে এই উপমহাদেশে কিরাত বলে উল্লেখ করা হতো। কিরাত শব্দটা সংস্কৃৃত ভাষার। আমরা শব্দটা ব্যবহার করছি এর একটা পটভূমি আছে বলে। কিরাত বলতে আমরা বুঝছি এমন মানুষকে, যাদের গণ্ডের হাড় উঁচু। আর এ কারণে তাদের মুখোমণ্ডলকে দেখে মনে হয় সমতল। এদের চোখের উপর পাতায় থাকে বিশেষ ধরনের ভাঁজ। যাকে বলে এপিক্যানথিক ফোল্ড। এ ধরনের ভাঁজ থাকার জন্য এদের চোখকে ছোট এবং বাঁকা মনে হয়। এদের মুখে দাড়িগোঁফ হয় না বললেই চলে। এদের মাথার চুল সোজা এবং খড়খড়ে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে এদের সহজেই চিহ্নিত করা চলে। এই উপমহাদেশের মানুষ নিয়ে প্রথম বই লেখেন হারবার্ড রিজলে। রিজলের বই (The People of India. Thaker Spink and Co. Calcutta. 1908) তে ভারতের জনসমষ্টির বিভাগ করা হয়েছে সাত ভাগে। কিন্তু এই সাত ভাগের মধ্যে তিনটি ভাগকে বলা যায় বিশুদ্ধ। এরা হলো : আর্য, দ্রাবিড় এবং মোঙ্গল (Mongoloid)। অপর চারটিকে বলা চলে মিশ্র। রিজলে বিশুদ্ধ দ্রাবিড় বলতে বুঝিয়েছেন ছোট নাগপুরের (বর্তমান ঝাড়খণ্ড) সাঁওতাল এবং মালাবরের নায়ারদের। এরা দৈহিক উচ্চতায় খর্বাকৃতির। গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চুলের রঙ কালো এবং কোঁকড়া হওয়ার প্রবণতাযুক্ত। এদের মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য থাকে। মাথার আকৃতি লম্বাটে। নাকের অগ্রভাগ চওড়া এবং মাংসল। তিনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বলেছেন একটি মিশ্র মানবধারা (Mongolo-Dravidian)। তিনি মনে করেছেন এদের উদ্ভব হয়েছে দ্রাবিড় ও মোঙ্গল মানবধারার মানুষের মধ্যে সাংকর্যের ফলে। তিনি ভারতীয় আর্য (Indo-Aryan) বলতে বুঝিয়েছেন এমন মানুষকে, যারা দৈহিক আকৃতিতে লম্বা, যাদের গায়ের রঙ তুলনামূলকভাবে ফর্সা, যাদের মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য থাকে, যাদের মাথার আকৃতি লম্বা এবং নাক সরু ও উঁচু। রিজলের এই মানব-বিভাগকে এখন অনেকেই মানতে চান না। কিন্তু এই বিভাগ এখনো যতগুলো বিভাগ করা হয়েছে, তার মধ্যে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলেই অনেক দিক থেকেই মনে করা যায়। আমরা মানবধারার কথা (Racial type) বলছি, কেননা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনীতিতে মানবধারার সঙ্ঘাত আবার একটা রাজনৈতিক জটিলতার বিষয় হয়ে উঠছে। যাকে বলে হিন্দুত্ব, তার ভিত্তি হলো আর্য জাতির ধারণা ও সংস্কৃত ভাষা। আজকের বিজিপিকে বুঝতে হলে তাই সংস্কৃত ভাষা (দেবভাষা) ও আর্য জাতির ধারণাকে বিবেচনায় নিতে হয়। ক’দিন আগে ত্রিপুরায় প্রাদেশিক পরিষদের ভোটে বিজিপি জয়ী হয়েছে। কিন্তু বিজিপির এই বিরাট জয়ের পেছনে আছে ইনডিপেনডেন্ট পিপলস ফ্রন্টের (আইপিএফটি) বিশেষ দান। এই দলের সভাপতি নরেন্দ্র চন্দ্র দেব বর্মা।
ইনি চাচ্ছেন ত্রিপুরাকে ভাগ করতে। ত্রিপুরা ব্রিটিশ শাসনামলে ছিল একটি করদমিত্র রাজ্য। ত্রিপুরা বংশের রাজাদের নাম থেকে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব হয়েছে। অনেকের মতে, ত্রিপুরা হলো ‘টিপ্রা’ নামক উপজাতির সংস্কৃত রূপ মাত্র। টিপ্রারা হলো মঙ্গোলীয় মানবধারার মানুষ। এরা যে ভাষায় কথা বলে, তা হলো চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায়; আর্য পরিবারভুক্ত ভাষায় নয়। এদের আছে ত্রিপুরায় নয়টি সংরক্ষিত আসন। এই নয়টির মধ্যে আটটিতে জয়ী হয়েছে আইপিএফটি। আইপিএফটি এখন বলছে, ত্রিপুরাকে ভাগ করতে হবে। ত্রিপুরীরা দাবি করছে একটা পৃথক প্রদেশ। তাই বলা চলে না বিজিপির হিন্দুত্ববাদ ত্রিপুরায় জয়লাভ করেছে। কেননা, ত্রিপুরা হতে যাচ্ছে বিভক্ত। উপজাতিরা দাবি করছে পৃথক প্রদেশ। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ হলো উপজাতি। এদের মধ্যে আবার ত্রিপুররাই হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্য উপজাতিরা এ ক্ষেত্রে জোট বাঁধছে ত্রিপুর দের সাথে; ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে নয়। ত্রিপুরার হিন্দু বাংলা ভাষাভাষীরা সমর্থন করছে বিজিপিকে। ধর্মের দিক থেকে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ দশমিক ৬ ভাগ হিন্দু। শতকরা ৭ দশমিক ৯ ভাগ বাংলাভাষী মুসলমান। খ্রিষ্টান শতকরা ৩ দশমিক ২ ভাগ। বৌদ্ধ শতকরা ৩ দশমিক ১ ভাগ। অন্যরা শতকরা শূন্য দশমিক ১৫ ভাগ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ত্রিপুররা ধর্মে হলো হিন্দু। তারা শিবের পূজা করে। কিন্তু তাদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে জাতীয়তাবোধের অর্থাৎ বিজিপির হিন্দুত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। থাকলে তারা এখন ত্রিপুরাকে ভাগের কথা উঠাত না। ত্রিপুরার ইতিহাসের অনেক কথা জানা যায় ‘রাজমালা’ নামক বই পড়ে। পূর্বে রাজমালা ত্রিপুর ভাষাতে লিখিত ছিল। ১৪৫৮ সালে ত্রিপুরার মহারাজ ধর্মমাণিক্যের আদেশে বইটি বাংলায় অনূদিত হয়। ত্রিপুরার মহারাজা রতœফার রাজত্বের সময় ১০ হাজার ঘর বাঙালি হিন্দু নিয়ে নিজ রাজ্যে বসতি করান। তদবধি বাংলার সংস্কৃতি ত্রিপুরা রাজ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়। কিন্তু ত্রিপুরার রাজারা শিবের পূজায় সহস্র সহস্র বাঙালি হিন্দুকে বলি দিত। ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্য এই বলিদান বন্ধ করেন। ত্রিপুরার রাজা লক্ষণমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৭৩২-১৭৬০) সমশের গাজী নামক একজন মুসলমান ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। তিনি ত্রিপুরায় প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। কার্যত এই সময় তাকে বলা যেতে পারে ত্রিপুরার প্রকৃত রাজা। সমশের গাজী প্রত্যেক জিনিসের মূল্য বেঁধে দিয়েছিলেন। তার বেশি দামে কোনো জিনিস বাজারে বিক্রি করা যেত না। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা বাংলাদেশের রেলজংশন আখাউড়া থেকে ৯ দশমিত ৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনামলে আখাউড়া জংশনে নেমে আগরতলায় ঘোড়ার গাড়িতে যেতে হতো। ত্রিপুরার তিন দিকে হলো বাংলাদেশ। উত্তর-পূর্বে হলো ভারতের আসাম প্রদেশ আর পুবে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ। ত্রিপুররা যে কেবল ত্রিপুরাতেই থাকে, তা নয়। অনেক ত্রিপুর বাস করে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলায়। খাগড়াছড়ি ত্রিপুরার সাথে লাগোয়া। খাগড়াছড়ির ত্রিপুররা বাংলাদেশের নাগরিক। তাই ত্রিপুরার রাজনীতি নিয়ে আমাদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। কেননা, ত্রিপুরা ভারতের প্রদেশ হলেও, তা বাংলাদেশের সাথে বিশেষভাবে সংযুক্ত। খাগড়াছড়িতে ত্রিপুররা ত্রিপুরা থেকে হেঁটেই আসতে পারে। সে রকম রাস্তা আছে আগে থেকেই। ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার সাতটি প্রদেশ : অরুণাচল, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরাকে এখন একত্রে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘সাত ভগিনী-রাষ্ট্র’ (Seven Sister States)। এর মধ্যে ক্ষমতায় বিজিপি আছে আসামে এবং ত্রিপুরায়। অন্য পাঁচটিতে নয়। অন্য পাঁচটিতে বহু মানুষ গ্রহণ করেছে খ্রিষ্টধর্ম। তাই বিজিপির হিন্দুত্ব এই পাঁচটি প্রদেশে প্রাবল্য পেতে পারবে বলে অনুমিত হয় না। বিজিপি ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসে বুলডোজার দিয়ে সরকারিভাবে লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলল। অন্য দিকে আমরা দেখলাম এর প্রতিশোধ নিতে একদল লোক ভাঙল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি। শ্যামাপ্রসাদ স্থাপন করেছিলেন জনসঙ্ঘ দল। জনসঙ্ঘ বিজিপির অন্যতম পূর্বসূরি দল। অবশ্য বিজিপির সাথে নৈকট্য আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস)। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আগামী বছর ভারতের নির্বাচনে তিনি অন্যান্য ভারতীয় দলের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচন করবেন। নির্বাচনে বিজিপি পরাজিত হবে। তিনি ও তার জোট দিল্লিতে ক্ষমতা অধিকার করবেন। আসাম ও ত্রিপুরা আপাতত গেরুয়া ধারণ করলেও, সারা ভারত গেরুয়া বসন ধারণ করে থাকবে না। দিল্লিতে ক্ষমতায় আসবে অন্য জোট সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে (যার নাম এখন কেবলই বঙ্গ) একটি জনসভায় আওয়াজ তুলেছেন, ‘চলো চলো দিল্লি চলো’। এই আওয়াজ তুলেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। ব্রিটেনের সাথে যখন যুদ্ধ চলেছিল জাপানের। তিনি এই সময় গড়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানি সৈন্য ও আজাদ হিন্দ ফৌজ তদানীন্তন আসাম প্রদেশের কোহিমা শহরে ব্রিটিশ ফৌজের সাথে লড়াইয়ের সময় দিয়েছিল এই ধ্বনি। কোহিমা হলো এখন নাগাল্যান্ডের রাজধানী। সারা পশ্চিমবঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসু হয়ে উঠেছেন একটি জনপ্রিয় স্মৃতি। এই স্মৃতি ভারতের রাজনীতিতে একটা ভিন্ন প্রভাব সৃষ্টি করতেই পারে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.