৭ই মার্চের ভাষণ মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের পর ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। আজ সেই ভাষণের সম্মান ফিরে পাওয়া গেছে। এজন্য আমরা গর্বিত। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাষণটি ছিল প্রেরণাদায়ক। কিন্তু এ নিয়ে প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। আমাদের একটি প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী গতকাল খামারবাড়ী কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘৭ই মার্চের ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা’- শীর্ষক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাকে ওই ভাষণের প্রেক্ষাপট বিস্তারিতভাবে বলার অনুরোধ জানানো হয়। আমি মনে করি, এদেশের মানুষের এসব জানার অধিকার রয়েছে। আমাদের পরিবারের তো দু’জনই বেঁচে আছি। আর কেউ তো নেই। ওইসময়কার ঘটনার নীরব সাক্ষীও ছিলাম আমরা। তাই আমাদের থেকে আর কে ভালো বলতে পারবেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট সেমিনারের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ট্রাস্টের সভাপতি। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। আলোচনায় অংশ নেন দি এশিয়ান এজ এর সহযোগী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুরা হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৭ই মার্চের ভাষণের বিস্তারিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।  তিনি বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ কোনো লিখিত ভাষণ না, কোনো রিহার্সেল দিয়ে তৈরি করা ভাষণও না। এই ভাষণ দীর্ঘ ২৩ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। এই ভাষণের আবেদন যুগ যুগ ধরে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পৃথিবীর যে কোনও ভাষণের চেয়েও এই ভাষণ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এর কোনও তুলনা হয় না। এটি অতুলনীয় ভাষণ। ১৯৭৫ সালের পর ২১ বছর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল এ ভাষণ বাজানো। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এ ভাষণ আজ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ দিক-নির্দেশনা ছিল এ ভাষণ। ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন বাজানো হতো। ১৯৭৫ সালের পর হারিয়ে গিয়েছিল এ ভাষণ, বাঙালি জাতি তা আবারও ফিরে পেয়েছে। শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্ব এ ভাষণ নিয়ে গর্বিত। এ সময় ছয় দফাকে মুক্তির সনদ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছয় দফার বিপরীতে একটি আট দফা দেয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে দলের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয় ছয় দফা থেকে আমরা বিচ্যুত হবো না। এর আগে আগরতলা মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। এ হত্যাই ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা-পরিকল্পনার একটা অংশ। এরপর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ফলে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। এরপর তিনি লন্ডনে যান। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিটিং করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিতবে কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনি সেখানে বসেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হয়ে আসার পর প্রায়ই বলতেন- আমার ছয় দফা মানে বলেই তিনি একটা আঙ্গুল দেখাতেন। তখন এই কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা নিষেধ ছিল। আমরা এ কারণে ইশারাতেই সব বুঝে যেতাম। তিনি আরও বলেন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল’ল দেয়ার সময়েই তিনি স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ছাত্রলীগকে দিয়ে ১৯৬২ সালের পর থেকেই একটা ‘নিউক্লিয়াস’ তিনি ফর্ম করেছিলেন। প্রতিটি জেলায়-মহকুমায় তিন সদস্যের কমিটি ছিল। স্বাধীনতার প্রস্তুতি অনেক আগেই নেয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাদের নিয়েই মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু কোনোদিন আগাম কথা বলেননি। কারণ, একটি লক্ষ্য স্থির করে তিনি কেবল ধাপে ধাপে আগাচ্ছিলেন না- জাতিকে প্রস্তুুত করছিলেন তিনি। স্মৃতিচারণ করে বলেন, একটি যুদ্ধের যত ধরনের প্রস্তুতি নেয়া দরকার। দেখবেন, ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগকে তিনি বলেন, মহকুমাগুলোতে তিন সদস্যের কমিটি হবে। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু আগরতলায় গিয়েছিলেন। যেদিন ফেরেন, সেদিনই গ্রেপ্তার হন। যদিও মামলা দিয়ে তারা কিছুই করতে পারেনি। বাংলার মানুষ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, তখন ২০ দলীয় ঐক্যজোট করা হয়েছিল। এখনও তাই আছে। বোঝাই যাচ্ছিল ৫০-৬০টি সিট পাবেই আওয়ামী লীগ। তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা আইবি ডিপার্টমেন্টে যারা বাঙালি কাজ করত, তারা সহায়তা করেছে। তারা কখনও রিপোর্ট দেয়নি আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মাত্র দুইটা সিট আমি পাব না- বাকিগুলো পাবো। সে সময় আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলেন। পাকিস্তানিরা ভাবতেও পারেনি, বাঙালিরা ক্ষমতায় আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি সরাসরি বলেননি, আবার বাদও রাখেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেছেন, ভাই-ভাই হিসেবে থাকার একটা সম্ভাবনা হবে- তিনি বলেননি আমরা এক হয়ে থাকব। তাদের আচরণের ওপর নির্ভর করবে মুখ দেখা-দেখি হবে কি না। মুক্তিযুদ্ধে কার, কি ভূমিকা তা তিনি বলে গেছেন। এখন ইউটিউবে দেখবেন, প্রতিটা সাক্ষাৎকারে তিনি সব বলেছেন কিন্তু পাকিস্তানিদের ধরার সুযোগ ছিল না। তিনি বলতেন, আমি বাংলার মানুষের মুক্তি চাই। পাকিস্তানিরা বুঝে উঠতে পারছিল না কি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইয়াহিয়া খান ২৬ তারিখে ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলেন। বলেছিলেন তার সাজা হবে। আইয়ুব খানের ডায়েরিতে পাওয়া যায়, কোর্টে ঢুকেই বঙ্গবন্ধু বলতেন, জয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে সেই ব্যবস্থা করে এসেছি। ৭ই মার্চ ভাষণ দেয়ার আগে অনেক চাপ, নেতারা বলছেন এটা বলতে হবে- ওটা বলতে হবে, চিরকুট দিচ্ছেন। আমার মা তখন সব কাগজ নিয়ে নিলেন। বাবাকে বললেন, তুমি চুপ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। তুমি সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছ। তোমার যা মনে আসবে, তুমি তাই বলবে। ওটা কোনো লিখিত বক্তব্য ছিল না। অথচ তিনি বলে গেলেন, কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে। কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ ৭৫’র পরে বাজানো নিষেধ ছিল। একটি প্রজন্ম কিছু জানতেই পারেনি। তাদের বিকৃত ইতিহাস জানানো হয়েছে। আজকে সেই ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আমরা এগিয়ে যাব। বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

No comments

Powered by Blogger.