মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন by মো: মতিউর রহমান

স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পার হয়ে গেল। এখনো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষের শক্তি’ বলে জাতিকে বিভক্ত করে রাখার একটা সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রয়াসের বিস্তার ঘটেছে চাকরিজীবীদের মধ্যেও। চাকরিতে কম মেধাবী ও কম দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতাসীন দলের এ নীতি বা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সুর মিলিয়ে বা সংহতি প্রকাশ করে অধিক মেধাবী ও অধিক দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি ও উচ্চপদে পোস্টিং বাগিয়ে নিচ্ছেন। মূলত বিভাজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নয়, এ সম্পর্কে সঠিক বোধ ও ব্যাখ্যা নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতে, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ছোট আরো কয়েকটি দল এ চেতনায় বিশ্বাসী। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই মৌলনীতিগুলো পরিবর্তন করা হলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এই চারটি মূলনীতি পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার ঘোষক ইস্যুর মতো সংবিধানের মৌলনীতির প্রশ্নেও এখনো রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে। সংবিধানে সন্নিবেশিত চার মৌলনীতির অন্যতম নীতি, সমাজতন্ত্রে কি আওয়ামী লীগ এখনো বিশ্বাসী? যদি তা-ই হয়, তাহলে তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করছেন না কেন? প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক দল নয়।
এর গঠনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের কথা নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা মুক্তিযুদ্ধকালে কেউ কখনো শোনেনি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সমাজতন্ত্র কী তা বুঝেনও না। কেননা, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত। প্রকৃতপক্ষে অনেকটা ভারতীয় সংবিধানের আদলে ওই মৌলনীতিগুলো আওয়ামী লীগ সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছে। সংবিধানের চার মৌলনীতির একটি হলো গণতন্ত্র। তাহলে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা বাকশাল গঠন করল কী করে? এটা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নয়? প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনেরা নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিজস্ব ব্যাখ্যাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল (অব:) এম এ জি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের তথা গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থী ‘বাকশাল’ কায়েম করায় তিনি প্রতিবাদে সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করেছিলেন এবং পরে নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এ কারণেই আওয়ামী লীগ তাকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শনে অনীহা প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. জে. (অব:) মীর শওকত আলী এবং উইং কমান্ডার (অব:) হামিদুল্লাহ খানের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ শোকবাণী পর্যন্ত দেয়নি। কারণ, তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এ ছাড়া ‘বীর উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাদের কাছে ‘পাকিস্তানি চর’। কারণ তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ সন্নিবেশিত করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি দেশ গড়ার মানসে বিভাজনের পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক রাজনীতি প্রবর্তন করেন। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম নাকি কোনো মুক্তিযুদ্ধই করেননি। কারণ, তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ঘোরতরভক্ত হলেও আওয়ামী লীগের বর্তমান নীতি ও আদর্শের তীব্র সমালোচক। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব দলীয় সম্পদ মনে করে। তা না হলে দলটি বিএনপি কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করে কিভাবে? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
আওয়ামী লীগের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে বিসর্জন দেয়া। উদাহরণস্বরূপ, তারা ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ কুরআনের এই আয়াত বাদ দিয়েছিলেন। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে হল দুটোর নামের অংশ হিসেবে ‘মুসলিম’ কথাটি পুনর্বহাল করা হলেও জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুসলিম’ কথাটি পুনঃসন্নিবেশিত হয়নি; কিন্তু ইসলামবিদ্বেষ কি ধর্মনিরপেক্ষতার নমুনা? সম্প্রতি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে। এটি এখন সংসদে পাসের অপেক্ষায়। এই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে নিজেদের দলীয় ব্যাখ্যা পুরো জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে এবং এতে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে না। এই আইনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এর পটভূমি ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো গবেষণায় আওয়ামী লীগের মতের বাইরে কোনো নতুন তথ্য পাওয়া গেলে তা কি প্রকাশ করা যাবে না? এর ফলে কোনো সভা-সেমিনারে কিংবা টকশো বা বিতর্কে কোনো ভিন্নমত কি ব্যক্ত করা যাবে? উল্লেখ্য, এসব বিষয়ে দেশী-বিদেশীদের লেখার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য বের হয়ে আসছে স্বাভাবিকভাবেই। এই প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ ভিতরে বাইরে’ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমেদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। বই দু’টিতে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জনগণ জানতে পেরেছে। প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন কিছু জানার বা প্রকাশ করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এটা ঘটলে তা হবে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও পরিপন্থী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ন্যায়বিচারের মধ্যে মানুষের বাকস্বাধীনতাও রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে জনগণের কণ্ঠরোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এভাবে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিলে একপর্যায়ে সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভয় হলো, পুলিশ স্বেচ্ছায় কিংবা সরকারের নির্দেশে এই আইনের বিশেষ করে এর ৩২ ধারার অপব্যবহার করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞায় ফেলে একজন সাংবাদিককে ‘জেলের ভাত খাওয়ার’ ব্যবস্থা করতে পারেন। মত প্রকাশ তথা গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার যেকোনা আইন প্রণয়ন করা হবে গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিধৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই ছিল বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং চিন্তাচেতনার সঠিক প্রতিফলন, যা পঞ্চম সংশোধনীতে ভিন্ন বাক্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আর আইনের শাসনভিত্তিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাই পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সফল রূপায়ন ঘটাতে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।

No comments

Powered by Blogger.