পরিবেশ বিপর্যয় ও পাহাড়ে ধস

পবিত্র ঈদুল ফিতর খুশির বার্তা বয়ে আনুক দেশের রাজনীতিতে। পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা, সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতার অনাবিল পরিবেশ সৃষ্টি হোক এই অঙ্গনে। রাজনীতিতে মত ও পথের ভিন্নতা সব সময় থাকবে। তদুপরি এই মতপার্থক্য গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি দলের রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং জনসেবার কর্মসূচিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ পদ্ধতি থাকবে। তার ভালো-মন্দ নিয়ে তর্কবিতর্ক হবে, সমালোচনা, পর্যালোচনা হবে। এটা কোনো দোষনীয় ব্যাপার নয় বরং স্বাভাবিক। তবে নীতি-আদর্শের এই তর্কবিতর্ক সমালোচনা অবশ্যই একটা সীমার মধ্যে থাকবে। এসব বক্তব্য যাতে কোনোভাবেই ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনকে সংক্রমিত না করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কও সাক্ষাতে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমরা অহরহ দেখি, দুই আদর্শের পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা ব্যক্তিরা নির্বাচনে বিজয়ী হন। প্রথমেই তার প্রতিপক্ষ তাকে বিজয়ী হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানান এবং নিজের বা দলের পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। গণতন্ত্রের এই সুবাতাস কবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বইবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই চমৎকার পরিবর্তনের আকাক্সা নিয়ে আর কত সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক যে ধারা দেশে চলছে তার আশুপরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয় অর্থাৎ মুখ্য বিষয় কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজনীতিতে রাজনৈতিক বিষয় গুরুত্ব পাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন যে সমস্যা প্রকট হয় তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার দাবি রাখে। দেশের এখন অন্যতম বড় সমস্যা পরিবেশ সম্পর্কিত। কিন্তু রাজনীতিতে এই সমস্যা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।
দেশের পরিবেশের প্রতিনিয়ত অবনতি ঘটছে, কিন্তু তার তেমন কোনো গুরুত্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই। মানুষ ও তার চার পাশের গাছপালা, ঘরবাড়ি, পাহাড়-পর্বত, মাটি, পানি, বায়ু, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, সমাজ-সংসার, ধর্ম, সংস্কৃতি এসব মিলিয়েই গোটা প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বিষয়টি গোটা দেশের কাছে বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ দেশে যেভাবে ক্রমাগত পরিবেশের অবনতি ঘটছে তাতে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। এখনই এ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় নেয়া উচিত। পরিবেশের প্রধান উপাদান মাটি, পানি ও বাতাস এবং অন্যান্য উপাদানের যেকোনো ধরনের পরিবর্তন যা সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে, সাথে সাথে বা পরবর্তীতে, অল্প বা বেশি সময়ের জন্য মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সেটাকেই মূলত পরিবেশ দূষণ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে শুষ্ক মওসুমে নদনদী শুকিয়ে যাচ্ছে, বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে পড়ছে, বন উজাড় হচ্ছে এবং বিশেষত শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ ঘটছে। এসব প্রতিরোধে বহু আইনকানুন রয়েছে, কিন্তু তার কোনো সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। পরিবেশ রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। দেশের পরিবেশগত সমস্যাগুলোর স্বরূপ কী তা কমবেশি সবার জানা। এ বিষয়ে অনেক নীতি, আইন, কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা আছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। যারা বন, জলাভূমি ও পরিবেশ ধ্বংস করছে তারা এত শক্তিশালী যে, বেসরকারি সংস্থা নাগরিক সমাজ একযোগে দাঁড়ালেও তাদের সাথে পেরে উঠবে না। সরকারের হাত এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও তা দূষণ রোধে তেমনভাবে প্রসারিত হয় না। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিবেশের বিষয়টি খুব গুরুত্ব পাচ্ছে না। পরিবেশগত কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে। এর প্রতিক্রিয়ায় জীবন ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক অবনতি ঘটছে। দেশের মানুষের ওপর তার অশুভ প্রভাব পড়ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে যতটা সতর্ক ও সোচ্চার সে তুলনায় বাংলাদেশে সচেতনতা অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশের বাতাস ইতোমধ্যে পৃথিবীর দূষিত বাতাসের অংশ হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই তথ্য জানা গেছে। এই সূচক অনুসারে, সার্বিক দূষণের ক্ষেত্রে ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৯তম স্থানে রয়েছে। পরিবেশ সূচকের প্রতিবেদন অনুসারে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এই সূচকের নিচের সারির দেশগুলো পরিবেশ দূষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যায়। এই সূচক নির্ণয়ে ৯টি পরিবেশগত বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এগুলো হলো বায়ুর মান, স্বাস্থ্যগত প্রভাব, পানি, স্যানিটেশন, পানিসম্পদ, কৃষি, বনভূমি মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও বসতি এবং জলবায়ু ও জ্বালানিসম্পদ। ৯টি বিষয়ের মধ্যে প্রতিটি দেশের জাতীয় পর্যায়ের ২০ ধরনের পরিবেশ তথ্য এই সূচক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটিতে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে দেশগুলোর অবস্থান নম্বর দেয়া হয়। মানের দিক থেকে বাংলাদেশের বায়ু ১০০ নম্বরে পেয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৮৩, যা বিশ্বে সর্বনি¤েœ। সামগ্রিক বিবেচনায় অর্থাৎ পরিবেশের ৯টি সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৯। এই বিবেচনায় সার্কভুক্ত কোনো দেশই বাংলাদেশের পেছনে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পরিবেশের সার্বিক অবস্থান সবচেয়ে ভালো শ্রীলঙ্কার। ৫৩ দশমিক ৮৮ নম্বর নিয়ে দেশটির অবস্থান ৬৯-এ। পানি স্যানিটেশনে ২২ দশমিক ৫৬ নম্বর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১। বনভূমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২২ দশমিক ৮৩ নম্বর নিয়ে আছে ৮৮তম স্থানে। এ ক্ষেত্রেও দক্ষিণ এশিয়ার সব ক’টি দেশই বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে। পানিসম্পদে বাংলাদেশের নম্বর শূন্য, মানে কোনো অর্জনই নেই। আর অবস্থান ১৪৫। বাংলাদেশের শূন্য পাওয়া আর একটি ক্ষেত্র হলো মৎস্য খাত।
এ ক্ষেত্রে অবস্থান ৯৮। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য ও বসতির ক্ষেত্রে পেয়েছে ৩৯ দশমিক ৬৮, অবস্থান ১২৩। জলবায়ু ও জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগের নিরিখে ৫৫ নম্বর পেয়েছে। পরিবেশবিদরা মনে করেন, বায়ুর মান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পরিবেশের সার্বিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইডের প্রাবল্য ক্রমেই মানুষের রোগবালাই বাড়িয়ে তুলছে। দেশের পরিবেশ প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল। পরিবেশের বিষয়টি শিল্প, অর্থবাণিজ্য ও প্রশাসনের কাছে ন্যুব্জ হয়ে আছে। ব্যতিক্রমধর্মী ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। উজানের প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি নেমে আসে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী দিয়ে। এই পানির মাত্র শতকরা ৮ ভাগ নিষ্কাশন এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্গত। বেশির ভাগ নিষ্কাশন অববাহিকা প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবস্থিত। বিশাল প্রবাহসহ নদ-নদীগুলোর গতি বাংলাদেশ নামের গাঙ্গেয় বাংলাদেশে ২৫০টির বেশি বড় নদনদী রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদনদীগুলো পরিবর্তনশীল। মেঘনা, পদ্মা ও যমুনা খুবই পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের উন্নয়নে এবং পরিবেশগত বিবেচনায় খুবই গুরুত্ব রাখে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর প্লাবন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে। বাংলাদেশে তিন ধরনের প্লাবন বা বন্যা হয়ে থাকে : আকস্মিক বন্যা, মওসুমি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়জনিত বন্যা। এসব দুর্যোগের কারণে নদীর তীর ভাঙে এবং জমি বিলীন ও ফসলহানি হয়। তাতে গ্রামবাংলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সর্বত্র এক মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং বন্যা নিয়ে বাঁচতে হবে যাতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে পরিবেশগত বিপদকে হ্রাস করে চলা যায় এমন কৌশলই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত ‘বন্যা নিয়ে বাঁচার’ কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়নি। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডেই মূলত পরিবেশের উপাদানে অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটে। দূষণ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় মানুষের নিজস্ব স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত করা, যা প্রধানত বর্জ্য বা ক্ষতিকর পদার্থ দ্বারা বায়ু, পানি ও মাটি দূষণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ দূষণজনিত সমস্যা গুরুতর করে তুলেছে। অধিক জনসংখ্যা মানে, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিক ব্যবহার, যার পরিণাম অধিক দূষণ। কঠিন বর্জ্যজনিত দূষণ বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা। বিভিন্ন শহরে বিপুল পরিমাণে কঠিন বর্জ্য জমা হয়। বর্তমানে কেবল ঢাকা নগরীতেই প্রতিদিন ১৫০০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর পরিমাণ বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় প্রায় এক হাজার ছোট-বড় শিল্পকারখানা রয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত ক্ষতিকর বর্জ্য তৈরি হয় এবং এটা পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটায়। ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ১৪৯টি ছোট-বড় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছিল, সেখানে প্রতিদিন প্রায় ১৮ হাজার লিটার তরল এবং ১১৫ টন কঠিন বর্জ্য জমা হতো। এসব বর্জ্য নিকটবর্তী নালা-নর্দমা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে নিক্ষেপ করার ফলে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ দিকে বাংলাদেশে শব্দের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এটা মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এক ধরনের অদৃশ্য দূষণ। শিল্প ও পৌরবর্জ্য বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষিত করছে। পরিবেশ অধিদফতর উল্লেখ করেছে যে, চট্টগ্রামের টিএসপি সার কারখানা থেকে সালফিউরিক ও ফসফরিক এসিড এবং চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজমিল, সিলেট কাগজমিল, দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি, খুলনার শিপইয়ার্ড ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ঢাকায় বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাখ লাখ গ্যালন তরল বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদী ও জলাশয়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং পানি দূষণ ঘটাচ্ছে। শিল্পের দূষিত তরল বর্জ্য মাটিতে চুয়ানোর মাধ্যমে ভূগর্ভের পানিতে মিশে মাটির উপরে ও নিচে, উভয় পানির উৎসকে দূষিত করছে। আশির দশকে মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণের কিছু কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘ সম্মেলনের পর বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো পরিবেশসংক্রান্ত কর্মসূচি শুরু করলে ১৯৭৪ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ গঠন করা হয় এবং ১৯৭৭ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে।
১৯৮৯ সালে বন বিভাগ এবং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ অধিদফতর নিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। ১৯৯০ সালকে পরিবেশ বর্ষ ও ১৯৯০-৯১ সালকে পরিবেশ দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও হালনাগাদ দুর্যোগ সম্পর্কে স্থায়ী নির্দেশাবলি ঘোষণা করে। পরিবেশের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা ও আইনকানুন যথেষ্ট রয়েছে। এসব বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সে পরিমাণ তাগিদ নেই। পরিবেশ বিষয়ে গোটা দেশবাসীকে সচেতন ও উদ্যোগী করে তোলার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠা আজো লক্ষ করা যায় না, বরং এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিছক রুটিন রক্ষা করার মতো, এর বেশি কিছু নয়। পরিবেশগত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার চাহিদা এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার সাথে সাথে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের দাবির নিরিখে অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর ইনস্টিটিউট, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোতে পরিবেশ শিক্ষাক্রম প্রচলন ও উন্নয়নের জোর দাবি উঠছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ শিক্ষাকার্যক্রম অন্যান্য বিষয়ের সাথে জড়িত, যাতে রয়েছেÑ ক. বিদ্যমান দুর্যোগগ্রস্ত ও দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে সতর্ক নজরদারি এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আসন্ন দুর্যোগ পরিস্থিতি, পরবর্তী চাহিদা ও ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রদান, খ. দুর্যোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস এবং দুর্যোগের আশু ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে গবেষণার জন্য ফোরাম গঠন, গ. পরিবেশ সমস্যা মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনায় কর্মরত সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং ঘ. বিদ্যমান বিভাগ ও আন্তঃবিষয়ক কার্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলপর্যায় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত পরিবেশবিদ্যার পাঠ্যক্রম প্রণয়ন। দেশে পরিবেশগত অবস্থা যা, তা মোকাবেলা করার জন্য পরিবেশবিষয়ক জ্ঞানলাভ জরুরি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু পরিবেশনীতি প্রণয়ন ও নীতিগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনেক। শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের পরিবেশ সমস্যাগুলো ব্যবস্থাপনায় জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে পরিবেশনীতি প্রণয়নের কৌশল অভিজ্ঞতাহীন একটি নতুন বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রশাসনপ্রক্রিয়া ও পরিবেশগত অগ্রাধিকারগুলো শিল্পোন্নত বিশ্বের অনুরূপ বিষয়গুলো থেকে অনেকখানি ভিন্ন। অধিকন্তু নীতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের তীব্র অভাব কাজটিকে কঠিন করেছে। আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বাংলাদেশকে টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনার একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র হিসেবে অভিহিত করা যায়। অত্যন্ত সীমিত সম্পদের ওপর ১৬ কোটি জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত চাপ বস্তুত সম্পদ ও পরিবেশের সহনশীলতা, উভয় বিবেচনায় দেশের ধারণক্ষমতাকে অতিক্রম করেছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে পরিবেশগত নীতি প্রণয়নের গুরুত্ব অত্যধিক। যারা দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছেন আর ভবিষ্যতে যারা গ্রহণ করবেন, তাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বটে; কিন্তু সার্বিক বিষয়টি বাস্তব ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখার পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টির সাথে দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। সরকারি কর্তৃপক্ষের পরিবেশসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রুটিন রক্ষার জন্য কাজ করে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নীতিনির্ধারণের দায়সারাভাবে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশগত বিবেচনায় অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। এবার পার্বত্য জেলায় ভূমিধসে বহু মানুষের জীবননাশ হয়েছে। অথচ সরকারের সম্মুখেই নিয়ত অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা ও বন উজাড় হচ্ছে এবং পাহাড়ের কোলে অথবা পাদদেশে বিপদসঙ্কুল স্থানে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। তবুও নিয়মনীতি বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণের কোনো বালাই নেই। পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রতি বছর অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অথচ এসব ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং পরিবেশগত বিপর্যয় জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের রাজনীতিতে পাহাড়ের বিপর্যয়ের শোক, অনুতাপ লক্ষ করা যায় বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় রোধে করণীয় নিয়ে কোনো প্রত্যয় নেই। নেই কোনো ফলপ্রসূ বক্তব্য।

No comments

Powered by Blogger.