কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি প্রদান প্রসঙ্গে

বিগত ১৩ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার হেড লাইন হচ্ছে ‘রাজনীতিতে অশনিসংকেত’। ১১ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে তিনশ’র বেশি আলেমকে সঙ্গে নিয়ে এক বৈঠক করেন। এ বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, উচ্চতম সনদকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রির তুল্য ঘোষণা, সুপ্রিমকোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক ভাস্কর্য সরানো ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী হেফাজতে ইসলামের সব দাবিই মেনে নেন। তাছাড়া এ বছর ১ বৈশাখের কর্মসূচি খর্ব করে বিকাল পাঁচটার মধ্যে সবকিছু শেষ করার নির্দেশও সরকার থেকে দেয়া হয়। ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে নতি স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী ঘরানার নেতানেত্রী এবং তাদের বুদ্ধিজীবী, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীরা যে সমালোচনা ও বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম আলো উপরোক্ত শিরোনামে সেগুলো প্রকাশ করেছে। অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক শেখ হাসিনার এহেন ধর্মপ্রীতি এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে নতি স্বীকারের কারণে তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত লেগেছে! এ প্রতিক্রিয়া শুধু প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী, লেখক ইত্যাদিই নয়, অন্য বুদ্ধিজীবী, লেখকরাও অন্যান্য পত্রিকায় সমালোচনামূলক মন্তব্য প্রকাশ করেছেন! এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে প্রথম আলোর উপরোক্ত সংবাদ হেড লাইন ‘রাজনীতিতে অশনিসংকেত’ না হয়ে হওয়া দরকার ছিল ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে অশনিসংকেত’। কারণ যা কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হচ্ছে সেগুলো সবই আওয়ামী লীগের কর্ম এবং যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন তারাও হলেন আওয়ামী ঘরানারই খুব পরিচিত রাজনৈতিক লোকজন এবং লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবী। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে থেকে হেফাজতে ইসলাম থেকে শুরু করে এ ধরনের সংগঠনগুলো দেশের প্রভূত ক্ষতি করছে। দেখা যাচ্ছে,
পাকিস্তানিরা ধর্ম নিয়ে যে খেলা খেলত তার থেকেও বিপজ্জনক এই খেলা। এর অন্যতম প্রমাণ হল এই যে, যারা দেশের সরকার পরিচালনা করে, তারা এমনভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করছে, যা পাকিস্তানিরা কোনোদিন করেনি অথবা এ দেশে করার মতো সাহস তাদের থাকেনি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র দোহাই দিয়ে এখন যা ইচ্ছে তা-ই করছে। প্রকৃতপক্ষে ও কার্যত হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফতে মজলিস ইত্যাদি নামধারী সংগঠনগুলো ইসলামের লেবাস পরে যেভাবে দেশের জনগণের সংস্কৃতি ও জনগণের সাধারণভাবে যে ক্ষতি করছে, ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধার লেবাস পরে দেশের ও জনগণের ক্ষতি করছে, নিজেদের ভোটব্যাংক নিশ্চিত করার জন্য ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী, তাদের সহযোগী সব রাজনৈতিক দল, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তাদের থেকে নানাভাবে ফায়দা উঠানো লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবীরা একইভাবে এ কাজ করছেন। লক্ষ করার বিষয়, সরকার দেশের জনগণের ওপর, দেশের শ্রমজীবী গরিবদের ওপর যে চরম শোষণ-নির্যাতন জারি রেখেছে, সেসবের বিরুদ্ধে উপরোক্ত বুদ্ধিজীবীরা কোনোদিন একটি বাক্য ব্যয় না করলেও, কোনো সমালোচনা না করলেও এখন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রতিরোধের নামে তারা কথাবার্তা বলছেন! এরা সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি অন্যভাবে ব্যবহার করে থাকেন যাতে করে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা না যায়। এখন সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ভাস্কর্য অপসারণকে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়ে তারা এর বিরুদ্ধাচরণ করছেন। কিন্তু ভাস্কর্য অপসারণের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম যা করছে এটা কি সাম্প্রদায়িকতা?
এটা হল এক বিশ্রী ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাধারণ অর্থে প্রতিক্রিয়াশীলতা। কিন্তু একে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়ে এই বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করছেন! প্রধানমন্ত্রীও যে এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সমর্থন করে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন, একথা তারা বলছে না। ধর্মের নামে যা কিছু হচ্ছে তার সবই এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে হল সাম্প্রদায়িকতা!! এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা এই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীদের নেই। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তাদের কার্যকলাপ দেশে ধর্মীয় অনাচার এবং সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বন্ধ না করে, তাকে দুর্বল না করে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনৈতিক শক্তিই বৃদ্ধি করছে। এখানে বলা দরকার, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। যাতে বলা হয়েছিল, তারা ইসলাম এবং কোরআনের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা সহ্য করবেন না এবং সে রকম কাজ কেউ করলে তাকে বড় রকম শাস্তি দেয়া হবে। প্রকৃতপক্ষে সে সময় খেলাফত মজলিসের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এক ‘ব্লাসফেমি চুক্তি’ করেছিল!!! ধর্মের সেই নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যবহার করলেও আওয়ামী লীগের এই বুদ্ধিজীবীরা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি। দেশের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন, অনেক শিক্ষিত নাগরিক এবং জনগণের মধ্যে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ার একটা যুক্তি হিসেবে এই বুদ্ধিজীবীরা এবং আওয়ামী ঘরানার লোকরা বলে থাকেন যে, আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অলিখিত সমঝোতা করে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন থেকে নিয়ে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ‘ব্লাসফেমি চুক্তি’ এবং এখন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতায় এসে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের সমর্থকদের ভোট পাওয়ার চেষ্টায় যেভাবে কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বিএনপির একই ধরনের কার্যকলাপের কী পার্থক্য আছে? ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেশ থেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, এ কারণেই কি স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের জমিদারিতে পরিণত হয়েছে? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ ধ্বজাধারী হিসেবে জনগণ কি আওয়ামী লীগকে দেশে যা ইচ্ছে করার ক্ষমতা দিয়েছেন? নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করলেও সে নির্বাচনে জনগণ কি বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে এ ধরনের কোনো ম্যান্ডেট দিয়ে থাকেন? ২০০৮-এর নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ভুয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি জনগণের থেকে এ ধরনের কোনো ম্যান্ডেট পেয়েছে? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এর বৈদেশিক নীতি বলে কিছু আছে মনে হয় না। ভারতকে ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করে এরা ভারতের সঙ্গে অসম সমঝোতা করেছে। দেশের রাজনীতিতে এর থেকে বড় অশনিসংকেত আর কী হতে পারে?
কিন্তু উপরোক্ত বিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বত্বাধিকারী আওয়ামী ঘরানার লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেননি। এ সবই তাদের কাছে শিরোধার্য! বাংলাদেশ ভারতের এক বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক সরকারের সঙ্গে একতরফা চুক্তি করলেও এবং তিস্তার পানির ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতে সক্ষম না হলেও এই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীরা এ বিষয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতারও তারা বিরোধিতা করতেন না, যেমন তারা খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করেননি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতে গিয়ে এবং দেশে এসে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে যেসব সমঝোতা করেছে, তাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রকৃতপক্ষে অশনিসংকেত এক বাস্তব ব্যাপার। এই পরিস্থিতির বিপদ বুঝেই এখন তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে যেভাবে ভারতের সঙ্গে নতজানু প্রতিরক্ষা চুক্তির বিরুদ্ধে নয়, তিস্তার পানি না পাওয়ার বিরুদ্ধে নয়, হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে কওমি মাদ্রাসা সনদকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন, এটা বাস্তবিকই সরকারের দিক থেকে এক বড় প্রশংসার কাজ! মনে হয় তাদের এই প্রশংসনীয় কাজের জন্য তাদেরকে শ্রদ্ধা করা উচিত!!
১৫.০৪.২০১৭
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.