জন্মদিন পালিত হল না সাযযাদ কাদিরের

কথা ছিল জন্মদিন পালনের, করতে হল স্মরণসভা। ১৪ এপ্রিল ২০১৭। বেঁচে থাকলে এদিন তিনি ৭০তম জন্মদিনে পা রাখতেন। এর আগেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গত ৬ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন তিনি। বলছিলাম বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদিরের কথা। গত ৩ এপ্রিল রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে সাযযাদ ভাইয়ের ফোন পাই। ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘এমদাদ, এবার পহেলা বৈশাখ আপনার ওখানে কাটাবো, বেরাইদ গণপাঠাগারে। দিনভর গল্প করব, নৌবিহারে যাব, বালু নদীর পানি ভালো আছে তো?’ আমি সানন্দে এ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে বললাম, আপনি যদি আসেন, আমাদের জন্য সৌভাগ্য। আগের দিন শুধু বলবেন, ক’জন আসছেন, ব্যস। ৬ এপ্রিল কর্মস্থল যুগান্তরের বার্তাকক্ষে কাজে ব্যস্ত। টিভি স্ক্রলে ভেসে ওঠে, ‘বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদির আর নেই’। যেন বিনামেঘে বজ্রপাত। সাবেক সহকর্মী জামালও টেলিফোনে খবরটি জানালেন। তারপর থেকেই ভাবছি, মানুষ এত সহজে বলা-কওয়া ছাড়াই কেন চলে যায়? আসলে মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য।
মৃত্যুর শীতল হাত সবাইকে স্পর্শ করবে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা ভবে, একজন যাবে অন্যজন রবে, এই ধারা চিরদিন চলিতে থাকিবে’- বলেছেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। বহুমাত্রিক কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদিরের সঙ্গে পরিচয় কর্মসূত্রে। আমি তখন দৈনিক মানবজমিনে কাজ করি। তিনিও সেখানে। আড্ডা-আলাপে এক সময় ‘বই পড়া’ প্রসঙ্গ ওঠে। তাকে বেরাইদ গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কথা জানাই। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ দেখান এবং পাঠাগারটি পরিদর্শনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আমিও উপলক্ষ খুঁজতে থাকি। বিভিন্ন সময়ে আমরা সৃজনশীল নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। তেমনি এক অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত করি। সেটা ছিল গুণীজন সংবর্ধনা। সেবার আমরা একজন শিক্ষককে বেছে নিই। তিনি হলেন, ১৯৫৪ সালে বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, পরবর্তীকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব সাদেক উদ্দিন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন সাযযাদ কাদির। তার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতায় দর্শক-শ্রোতারা মুগ্ধ। এলাকাবাসী পরে প্রায়ই তাকে আনার জন্য আমাকে তাগিদ দিতেন। তিনিও আগ্রহী ছিলেন। তিনি পাঁচবার বেরাইদ গণপাঠাগারে এসেছিলেন। উপহার দিয়েছেন পাঁচ শতাধিক বই। তার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তিনি এই গণপাঠাগারে দান করেছেন। এ জন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। সাযযাদ ভাই অত্যন্ত হাসি-খুশি, রসিক ও প্রাণখোলা স্বভাবের ছিলেন। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নেয়ার অসাধারণ গুণ ছিল তার। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যা স্বল্প কথায় লিখা সম্ভব নয়। মানবজমিনে তার ‘অল্প-স্বল্প-গল্প-কথা’ কলামটি অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। কাছেই বাসা, গ্রিন সুপার মার্কেটের পাশে। কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে কতদিন তার বাসায় গেছি, হিসাব নেই। কেবলই বইয়ের কথা, লেখালেখির কথা। বলতেন, ধৈর্য হারাবেন না, চালিয়ে যান।
তিনিও খুব ধৈর্যশীল ছিলেন। নিজের কষ্ট, বঞ্চনা, অপ্রাপ্তির কথা কাউকে শোনাতেন না। একবার আমার মেয়ের ‘ও লেভেল’ পরীক্ষা পড়েছে বসুন্ধরা সিটি কেন্দ্রে। দু’বেলা পরীক্ষা। বিরতির সময়টুকু তার বাসায় কাটালাম। ভাবির সাদর-সম্ভাষণ, আদর-আপ্যায়ন কখনোই ভুলবার নয়। সাযযাদ ভাইকে কখনও নিজ পরিবারের সদস্যের বাইরে ভাবতে পারিনি। মানুষটির সঙ্গে অনেকেই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ শেয়ার করতেন। তিনিও বড় ভাইয়ের মতো সবাইকে আগলে রাখতেন, সুপরামর্শ দিতেন। উদার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সাযযাদ কাদির। শুধু নিজে ভালো লিখলেই চলবে না, অন্যকেও শেখাতে হবে। এই ধারণা থেকে লেখালেখি, সম্পাদনা কৌশল শেখাতে নিজের বাসায় গড়ে তুলেন ‘বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’। বলতাম, নামটা অনেক বড় হয়ে গেছে। জবাবে বলেছেন, ‘চর্চাকেন্দ্র’ বলবেন। সেখান থেকে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। তার বাসায় কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষানবিসদের আড্ডা লেগেই থাকত, যেন মেলা বসেছে, সেই সঙ্গে ভাবির নিরলস আতিথেয়তা। তার দরবারে ভারতের কবি-সাহিত্যিকদেরও আনাগোনা ছিল। আমরা কেবলই নিয়েছি। বিনিময়ে পরিবারটিকে কিছুই দিতে পারিনি। তার কাছে আমাদের অশেষ ঋণ। ছুটির দিনে দেশময় ঘুরতে পছন্দ করতেন সাযযাদ ভাই। মানুষ ও প্রকৃতিকে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন। বলতেন, ‘পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে জটিল প্রাণী, যাকে বোঝা খুব কঠিন’। মানবজমিনের নির্বাহী সম্পাদক শামীমুল হকের আমন্ত্রণে একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরে সাযযাদ ভাইয়ের সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে কাটানো দুটি দিন আমার জীবনে ‘সোনালী স্মৃতি’ হয়ে আছে। কর্মস্থল পরিবর্তনের পর সাযযাদ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে, বিচ্ছিন্ন হয়নি।
মাস দুয়েক আগে বাসায় গিয়েছি। অতি সম্প্রতি তিনি ডা. লুৎফর রহমান, মহাকবি কায়কোবাদের জন্মভিটা ঘুরে এসেছেন। মুন্সীগঞ্জে একটি পাঠাগার উদ্বোধনের কথাও আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন। তার এই ‘খুঁজে ফেরা’র বাতিক আমারও আছে। কিন্তু সময়-সুয়োগ একেবারেই মেলে না। সাযযাদ কাদির ১৯৪৭ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার মিরের বেতকা গ্রামে তার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস একই জেলার দেলদুয়ার উপজেলায়। তিনি ১৯৬২ সালে বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে টাঙ্গাইল করটিয়া সা’দত কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হন। ১৯৭৬ সালে কলেজের চাকরি ত্যাগ করে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে বিচিত্রা ছেড়ে রেডিও বেইজিংয়ে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে রেডিও বেইজিংয়ের চাকরি ত্যাগ করেন। ১৯৮২-১৯৮৫ পর্যন্ত দৈনিক ‘সংবাদ’-এ কাজ করেন। ১৯৮৫-১৯৯২ সাল পর্যন্ত আগামী-তারকালোক পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৯২ সালে দৈনিক দিনকাল-এ যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে দিনকাল ছেড়ে বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটে যোগ দেন এবং সেখানে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০০৪ সালে দৈনিক মানবজমিনে যোগ দেন। সেখানেই থিতু হন, যুগ্ম-সম্পাদক পদে কর্মরত ছিলেন। সাযযাদ কাদিরের স্বচ্ছন্দ বিচরণ কবিতায়। তবে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা, শিশুসাহিত্য, সম্পাদনা, অনুবাদ সবকিছুতেই সমান পারদর্শী ছিলেন। অনেক নবীন লেখকের জন্ম তার হাতে। লেখালেখি, বই প্রকাশে সবরকমের সহযোগিতা করেছেন উদারভাবে। তিনি বিভন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থ লিখেছেন।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল : কাব্যগ্রন্থ- যথেচ্ছ ধ্রুপদ (১৯৭০), বৃষ্টিবিলীন (২০১২), গল্পগ্রন্থ- চন্দনে মৃগপদচিহ্ন (১৯৭৬), অনুবাদগ্রন্থ- লাভস্টোরি (১৯৭৭), রাজরূপসী, প্রেমচাঁপালী, হারেমের কাহিনী, সংকলন- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধসমগ্র, বেগম রোকেয়া প্রবন্ধসমগ্র, পৃথিবীর প্রিয় প্রণয়ী, উপন্যাস- অপর বেলায়, অন্তর্জাল (২০০৮), খেই (২০১২), গবেষণা- রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন (২০১২), রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি (২০১২), প্রবন্ধ- নারীঘটিত (২০১২)। পশ্চিমবঙ্গে নাথ সাহিত্য ও কৃষ্টিকেন্দ্রিক সাহিত্যপত্রিকা ‘শৈবভারতী’র ৩৪তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রবন্ধ সাহিত্যে সাযযাদ কাদিরকে ‘শৈবভারতী’ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। তার উদ্যোগে বেশকিছু সাহিত্যসভায় যোগ দিয়েছি। যতবার তার কাছে গেছি, ততবারই নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। বেরাইদ গণপাঠাগারের উপদেষ্টা, এই মহৎপ্রাণ লেখকের রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার; সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.