সরকার হেফাজতকে নিয়ে দোটানায়

বহুল আলোচিত হেফাজতে ইসলামের সাথে সম্পর্ক নিয়ে দোটানায় রয়েছে সরকার। সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকেরা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে হেফাজতে ইসলামের সাথে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। তারই অংশ হিসেবে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান ঘোষণা দেয়া হয়। এ ছাড়া হেফাজত নেতাদের দাবির পর পাঠ্যবই থেকে বিতর্কিত বিষয় সংশোধন এবং সর্বোচ্চ আদালত ভবনের সামনে থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য দিকে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী এবং বাম ঘরানার বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা হেফাজতের সাথে এ ধরনের সম্পর্ককে ‘আপস’ আখ্যায়িত করে তার বিরোধিতা করছেন। তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে সরকারের এ নীতির সমালোচনা করে বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সাথে এ ধরনের আপস বা নির্বাচনী সমঝোতা অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বাধাগ্রস্ত করবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামকে পাশে রেখে ধর্মীয় আবেগ নিজেদের পক্ষে রাখাই হলো এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। কওমিতে যে ভোটব্যাংক আছে, তা যেন কোনোভাবেই বিএনপির দিকে ঝুঁকতে না পারে, সে জন্য কিছু কৌশল নেয়া হয়েছে। এ কৌশল থেকেই নির্বাচনের আগে হেফাজতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে বাড়তি চাপ নিতে চায় না ক্ষমতাসীন দলটি। গত বুধবার আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়ও নির্বাচনের আগ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামকে কাছে রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের কারণেই হেফাজতের সাথে বিরোধে যাবে না আওয়ামী লীগ। কওমির সনদ, উচ্চ আদালত থেকে ভাস্কর্য অপসারণ হেফাজতকে খুশি করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পয়লা বৈশাখে দলের র‌্যালি বাতিলের পেছনে এসব অন্যতম কারণ। বর্তমানে কওমি মাদরাসায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৪ লাখ। রয়েছে এসব ছাত্র-ছাত্রীর পরিবার। হিসাব করলে এখানে বড় একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। সে জন্য ভোটব্যাংকের হিসাব মাথায় নিয়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে কাছে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। আর কোনোভাবেই এই ভোটব্যাংক হাতছাড়া করতে রাজি নয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি এসব শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টাও সনদের স্বীকৃতির পেছনে বড় কারণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগ সম্পাদকমণ্ডলীর তিনজন নেতা জানান, কওমি মাদরাসায় বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা যাতে নির্বাচনের আগে বিএনপির দিকে ঝুঁকতে না পারে, সে জন্যই কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ভোটের রাজনীতির স্বার্থে উচ্চ আদালত চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণ নিয়েও হেফাজতের যে দাবি, তার সাথে দ্বিমতে জড়াচ্ছে না ক্ষমতাসীন দলটি। তবে হেফাজতে ইসলামের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সখ্যের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে দলটির নেতাকর্মীদের অনেকের মাঝেই একধরনের বিভ্রান্তি এবং অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের কাছেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তারা বলেছেন,
এমন কোনো সখ্য হলে সেটা তাদের দল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। নেতারা জানান, হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে, এই অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। এর রেশ কাটতে-না-কাটতেই জোরালো বিতর্ক দেখা দেয় সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানোর প্রশ্নে হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফীসহ আলেমদের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে। উচ্চ আদালতের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণে হেফাজতের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলেমদের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য আমারও পছন্দ হয়নি।’ তার এমন বক্তব্য অনেকটা হেফাজতের দাবি মেনে নেয়ার মতো বলেই মনে করছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের নেতারা পয়লা বৈশাখ উদযাপনেরও বিরোধিতা করে আসছেন। তাদের দাবির কারণেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী পয়লা বৈশাখের র‌্যালিও বাদ দেয়া হয়েছে এবার। অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ একের পর এক ছাড় দিচ্ছে হেফাজতকে। এমন পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের নেতাদেরকেই অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভেতরে একধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননসহ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী হেফাজত নিয়ে সরকারের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন। এটিকে রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত বলেও আখ্যায়িত করেন তাদের কেউ কেউ। তবে আওয়ামী লীগে এসব বিষয় নিয়ে টানাপড়েনের অভিযোগ নাকচ করে দলটির নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বাদ দিয়ে তারা সবাইকে নিয়ে একসাথে চলতে চান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বাম ঘারানার একজন নেতা আলাপকালে বলেন, ‘ঢাকাকেন্দ্রিক হেফাজতের যে তাণ্ডব আমরা দেখেছি এরপরও হেফাজতের রাজনৈতিক মতের সাথে যদি কোনো সমঝোতা হয়, সেটা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য খুব বেশি মঙ্গলজনক হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। মাঠপর্যায়ে আমার সাথে যাদের কথা হয়, অনেকে উদ্বিগ্ন যে, এটা হচ্ছেটা কী? অথবা আসলে কী হয়েছে? এটা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার না।’
দলের সুবিধাবাদী কোনো অংশ এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দলে কোনো টানাপড়েন বা কারো মধ্যে অস্বস্তি থাকার কথা নাকচ করে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এখানে অস্বস্তি বোধ করার বিষয় নেই। একটা অংশ ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি কাঠামোর বাইরে ছিল। সেটাকে শেখ হাসিনা তাদের সাথে আলোচনা বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে কাঠামোর ভেতরে আনলেন।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধীদের বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়েই চলছে। আমরাই বলব, ইনকুসিভ সোসাইটি। আবার স্বাধীনতাবিরোধী বিষাক্তদের বাদ দিয়ে যখন সবাইকে নিয়ে চলার কথা আসে, তখন বলা হয় আওয়ামী লীগ আপস করছে। আমরা কিছু করলেই প্রশ্ন তোলা হয়। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ চলছে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ ব্যাপারে বলেন, ‘কওমি সনদ দেয়া হেফাজতের সাথে কোনো আপসের ফল নয়। রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা এবং জনগণের আবেগ-অনুভূতির সাথে সঙ্গতি রেখে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘কওমি মাদরাসায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়েÑ দেশ থেকে, সমাজ থেকে তাদের তো আমরা বের করে দিতে পারি না। তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এসব শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। তারা যেন জঙ্গিবাদে জড়াতে না পারে। এই উদ্দেশ্যেই কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এর পেছনে আর কোনো কারণ নেই।’

No comments

Powered by Blogger.