সাদা সোনায় দুর্দিন by ইমাদ উদ দীন

সাদা সোনা হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারের রাবার শিল্পের দুর্দিন যাচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগানগুলো এখন ধ্বংসের দোরগোড়ায়। এ জেলায় চা বাগানের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে রাবার বাগান গড়ে উঠেছিল। লাভজনক এ শিল্পটি এ অঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছিল দিন দিন। সম্প্রতি ব্যাহত হয়েছে বিকাশমান এ শিল্পের অগ্রযাত্রা। কারণ হঠাৎ করে ক্রমাগতভাবে রাবারের দরপতন। আর এ কারণে আর্থিক টানাপোড়নে দিশাহারা রাবারচাষিরা। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মৌলভীবাজারের ছোট-বড় অর্ধশতাধিক রাবার বাগান মালিক। তারা দৈনিক মজুরিতে থাকা বাগান শ্রমিকদের বেতন আর বাগান পরিচালনার খরচ চালিয়ে যেতেও হিমশিম খাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে বাগানগুলোতে প্রতিনিয়তই ছাঁটাই করা হচ্ছে শ্রমিক। কয়েক হাজার বাগান শ্রমিক প্রতিদিনই চাকরি হারানোর ভয়ে থাকেন তটস্থ। অনেকেই চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দেশের অন্যতম রাবার চাষের এ অঞ্চলটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখন উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। দিন দিন এ সংকট তীব্র হওয়ায় বাগান মালিকরা এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। অনেকেই রাবার গাছ কেটে তাতে ফলজ বা বনজ গাছের বাগান করার চিন্তা করছেন। বাগান মালিকদের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপ দিলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। রাবার বাগান মালিকরা জানালেন এখন চলছে তাদের চরম দুর্দিন। গেল বছর থেকেই রাবার শিল্পে এমন দুর্যোগের ঘনঘটা। গেল মওসুমে রাজনৈতিক অস্থিরতায় লাগাতার হরতাল অবরোধের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে সংগৃহীত কাঁচা মাল ঢাকায় না পাঠাতে পারায় স্টকে থাকা অধিকাংশ রাবার নষ্ট হয়ে যায়। আর হরতাল অবরোধ উঠলে হঠাৎ করে কাঁচা রাবারের দরও কমে যায়। এখনও এমন অবস্থা চলায় বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা রাবার স্টকে রেখে মালিকরা হতাশায় ভুগছেন। দাম বাড়ার আশায় বাগান মালিকরা আর্থিক বিরাট ক্ষতি থেকে বাঁচতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। কিন্তু  দিন যত যাচ্ছে স্টকে থাকা রাবার নষ্ট হতে চলছে। তারপরও বাড়ছে না দাম। হাতে পর্যাপ্ত রাবার থাকার পরও তা বিক্রি করতে না পারায় আর্থিক সংকটে বাগান মালিকরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বাগান মালিকরা জানালেন এখন অফ সিজন থাকায় কষ সংগ্রহের জন্য প্রতিটি বাগানে অতিরিক্ত শ্রমিক না থাকলেও বাগান পরিচর্যার নিয়মিত শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না তারা। চরম আর্থিক সংকটে থাকা অনেক ছোট বাগানে ইতিমধ্যেই ছাঁটাই করা হয়েছে নিয়মিত শ্রমিক। বাগান নিয়েও অন্য চিন্তা ভাবনা করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বাগান মালিকরা জানালেন একদিকে সিন্ডিকেট রাবার চোরাকারবারিদের কারণে তারা অতিষ্ট। বাগানের বড় গাছ কেটে নেয়া ছাড়াও বাগানগুলোর কষ দেয়া গাছে দ্রুত কষ সংগ্রহের জন্য প্রতিনিয়তই চোরাচক্র অবাধে রাবার গাছগুলোতে স্টেপিং করার কারণে মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে বাগানগুলোর কষ দেয়ার উপযুক্ত গাছ। এ কারণে দিন দিন ব্যাহত হচ্ছে বাগানের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন। অপরদিকে দিন দিন কমে যাচ্ছে কাঁচা রাবারের দরও। এমন অচল অবস্থায় মহা সঙ্কটে পড়েছেন ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট ছোট বাগান মালিকরা। এমন অবস্থা চললে বাগান ঠিকে কি করে এমন প্রশ্নে এখন মালিক শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই দুশ্চিন্তায় হতাশ। তাদের চোখে মুখেও এখন এমন  দুশ্চিন্তার চাপ। দিন দিন বাড়ছে এ উদ্বিগ্নতা। বাগান মালিক শাহ নেওয়াজ রাজা, সাকির আহমদ, মুসলিম মিয়া, এএনএম খালেদ লাকীসহ অনেকেই জানান, বাংলাদেশ বন শিল্প করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে থাকা সরকারি রাবার বাগান ও এইচআরসি, ফিনলে ও ডানকান কোম্পানির বাগানগুলোর (গুনগত মানের ভিত্তিতে) রাবারের দর নিয়ে কোন সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়েছেন ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান মালিকরা। তারা বলেন গেল বছর রাবারের কিছুটা দাম থাকলেও লাগাতার হরতাল অবরোধের কারণে তারা সময়মতো তা বিক্রি করতে পারেননি। তখন প্রতিকেজি রাবার ছিল ১২০-১৩০ টাকা । আর বর্তমানে প্রতি কেজি ৮০-৯০ (ভ্যাটসহ) টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তারা জানান ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত রাবার সিট (‘ধুমায়িত’ একটি প্রাথমিক প্রক্রিয়ার পর) প্রতিকেজি রাবার বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা। তারা একসময় তা সর্বোচ্চ ৪শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি আর এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা। তারা বলেন, এমনিতে এ অঞ্চলের রাবার শিল্প চোর চক্রের কারণে ধ্বংসের দোরগোড়ায় আর এভাবে ক্রমাগত দরপতন চলতে থাকলে রাবারচাষিরা তাদের বাগানের গাছ কেটে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না। গেল বছর থেকে লোকসান গুনা শুরু হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে বাগান রক্ষায় নিজেদের ভিটে মাটি বিক্রি করতে হবে। চাষিরা জানান, এক সময় রাবার কৃষিপণ্য হিসেবে বিপণন হতো। এরপর তা কৃষিপণ্য থেকে বাদ দিয়ে  তাতে ১৫ শতাংশ করারোপ করা হয় । কিন্তু তারপরও এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সরকারের তরফে কোন সহযোগিতা পাই না। বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক একেএম শাহজালাল জানান,  আমরা আমাদের এই দুর্দশার কথা সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছি। সরকারের সহযোগিতা না পেলে আমাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন  রাবার বাগানগুলো আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। এখন মহা হুমকিতে থাকা এ শিল্পটি রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে না এলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়বে । সরকারও কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে আর হুমকিতে পড়বে এ অঞ্চলের পরিবেশ।

No comments

Powered by Blogger.