দিল্লি নির্বাচন- ধনী-গরিবের লড়াই! by বন্দিতা মিশ্র

দিলি্লর এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে ভেদরেখাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে 'ধনী-গরিব'; 'নিম্নবিত্ত ও মধ্য-উচ্চবিত্ত'_ এভাবে ভোটারদের মধ্যে বিভক্তিটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সর্বজনস্বীকৃতভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী দিলি্লকে বিভিন্ন শ্রেণীবর্গে ভাগ করা সহজ নয়। তবে সাধারণভাবে বলতে গেলে দিলি্লর কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে, সেখান থেকে যমুনার ওপার এবং তা থেকে দক্ষিণ দিলি্ল ঘুরে এলে এই বিভক্তিটা আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ভোটারদের মধ্যকার শ্রেণী-বিভক্তিই নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে, একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যারা আম আদমি পার্টিকে ভোট দেবে বলছে তারা এবং বাদবাকিরা এভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। দিলি্লর বাইরের অংশে সবসময় যেখানে ময়লা-আবর্জনাময় পানিতে সয়লাব থাকে, সেই মেহরুলিতে বসবাসকারী নিরাপত্তা প্রহরী অটল বাহাদুর সিং, যার বাসার গলি এত সরু যে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত ঢুকতে পারে না, তার সঙ্গে যারা নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, তাদের কোন দলের প্রার্থীকে ভোট দেবে তার একটা স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। দিলি্লর চাঁদনি চকের এমব্রয়ডারি কারুশিল্পী শফিকউদ্দিনের মাথার ওপর রয়েছে আড়াআড়িভাবে বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের তার। বৃষ্টি এলে বিদ্যুতের তারে বিপজ্জনক স্পার্ক হয়। তার মতো লোকেদের এবং যারা অবিরাম সবকিছু চাইলেই হাতের কাছে পেয়ে যান, তাদের মধ্যে এবারের নির্বাচনে দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্থক্য নজরে আসছে।
আড়াই ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে দিলি্লতে কাজ করতে আসা এবং কাজ শেষে আড়াই ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা লোকেন্দ্র রানার সঙ্গে যাদের এতটা কষ্ট স্বীকার করতে হয় না তাদের মধ্যে ভোট কাকে দেবেন এ প্রশ্নে ভিন্ন মত রয়েছে। লোকেন্দ্রদের মতো লোকজনের অনেকের পছন্দ আম আদমি পার্টি।
রানা একজন পার্কিং তত্ত্বাবধানকারী। ২০ বছর আগে তিনি নেপাল থেকে দিলি্ল এসেছিলেন। এখন কাপসেরাতে ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তার কাছে অর্থনীতি মানে ক্রমবর্ধমান পানি ও বিদ্যুৎ বিল। যে কারণে তাকে দীর্ঘ পথ সাইকেলে পাড়ি দিয়ে কাজে আসতে হয়। কাজে আট ঘণ্টার সঙ্গে যাতায়াতের জন্য আরও ৫ ঘণ্টা সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হয় তাকে। তার মতে, সে বাসে করে কর্মস্থলে আসতে পারে। কিন্তু বাসে আসা-যাওয়া বাবদ তার খরচ পড়বে ৭০ রুপি। এত অর্থ বাসভাড়া বাবদ খরচ করলে তার মাসিক ৮ হাজার রুপি বেতনে সংসার চলবে কী করে! আর তিন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়াই-বা করাবেন কী করে! এদের মধ্যে আবার বড়টি এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে।
রানা বলেছেন, কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি পানি ও বিদ্যুৎ বিল হ্রাস করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় সে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত দিলি্ল বিধানসভা ও পরে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনেও ভোট দিয়েছিলেন। কেজরিওয়ালের দল যে ৪৯ দিন ক্ষমতায় ছিল সে সময়ে তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
দিলি্লতে ছোট মলের কর্মচারী পাটনার লোক অজিত কুমার সিংয়ের মতে, তার মতো চতুর্থ শ্রেণীর আম আদমির জন্য কেজরিওয়ালই দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি যদিও লোকসভা নির্বাচনের সময় মোদিকে পছন্দ করার কারণে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু আম আদমি পার্টির দিলি্লর ৪৯ দিনের রাজ্যপাট চালানোর সময় দক্ষিণ দিলি্ল থেকে সঙ্গম বিহার পর্যন্ত পানির অবারিত প্রবাহ এবং অটোওয়ালা ও অন্যদের যখন পুলিশকে ঘুষ দিতে হয় না দেখেন, তখন তিনি এই দলের প্রতি আবেগতাড়িত হন। এই ৪৯ দিনে ৫শ'টি ঘর তৈরি হয়েছে। এসব ঘর তার মতো লোকেরাই নির্মাণ করেছে। তারা আগে আধা বৈধ-আধা অবৈধ কলোনিতে বাস করতেন, যেখানে সবসময় এই বুঝি তুলে দেবে_ এ ধরনের ভীতি কাজ করত এবং পুলিশকে নিয়মিত ঘুষ দিতে হতো।
সঙ্গম বিহারের অনাদিষ্ট বাসিন্দা চিত্রকর সুশীল গৌরের ঘরের কাছে একটি খোলা কুয়া ছিল। প্রধান এটি এক সময় দখল করে নেয়। সে প্রত্যেকের কাছ থেকে এখান থেকে পানি নেওয়া বাবদ প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে আদায় করত। এই হার শেষ পর্যন্ত ৫শ' টাকায় পেঁৗছে। এরপর কেজরিওয়াল ক্ষমতায় এসে এই হার মাসিক একশ' টাকায় ধার্য করা হয়। সুশীল সে সময় তার ঘরের অতিরিক্ত তিন রুমের টিনের চালার একতলা বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হন। অতীতে পুলিশ ঘুষ নেওয়ার জন্য এলেও কেজরিওয়ালের সময় তাদের দেখা যায়নি।
এমনকি ২০১৪ সালে যখন মোদির পক্ষে জনসমর্থনের জোয়ার বইছিল, তখন পরিবারের অন্যরা মোদির পক্ষে ভোট দিলেও তিনি একা আম আদমি পার্টিকে নীরবে ভোট দিয়ে এসেছিলেন। মলে যারা রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার কাজ করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই আম আদমি পার্টিকে সমর্থন করে বলে স্বীকার করেছে। কেজরিওয়াল সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ, পানি ও দুর্নীতির ব্যাপারে সুফল পেয়েছিলেন বলে জানান তারা। কেজরিওয়ালকে সরকারের পদত্যাগের জন্য দায়ী করা হয় দেখে তারা হতাশা প্রকাশ করেন। তার এই পদত্যাগ বিজেপি ও কংগ্রেসের মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ ও মিডিয়ার বাড়াবাড়ি রকমের প্রচারণার ফল বলে তারা মনে করেন। বিপণি কেন্দ্রে এসবই অপ্রকাশিত বিভক্তি।
অন্যদিকে জরিপে দেখা গেছে, দোকান মালিকদের অধিকাংশই আবার মোদি-বিজেপি সমর্থক। বিশ্বে ভারতের নাম রওশন করা এবং মোদির ভিশন, অভিজ্ঞতা ও দৃঢ়তার জন্য তারা তাকে ও তার দলকে সমর্থন করেন। এদের অনেকে বলেছেন, তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু আর এ পার্টিকে ভোট দেবেন না বলে জানান। কারণ, তাদের মতে ট্যাক্স প্রদানকারীদের অর্থ নিয়ে কেজরিওয়াল লোকরঞ্জনকারী রাজনীতির খেলা খেলেন। তার সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব রয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, আরব্ধ কাজ সমাপ্ত না করে চলে যেতে পারেন ও তিনি একজন অপরিপকস্ফ ব্যক্তি।
নিউ ফ্রেন্ডস কলোনিতে বসবাসকারী একতা গুপ্তা মনে করেন, তিনি একজন একনিষ্ঠ বিজেপি সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ২০১৩ সালে তিনি দিলি্লর বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে ভোট দিয়েছিলেন। কারণ, তখন দলটির সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কেজরিওয়াল একেবারেই অদক্ষ এবং বিদ্যুৎ বিল হ্রাস করে তিনি সীমিত সংখ্যক লোককে মাত্র উপকৃত করতে পেরেছিলেন। মোদি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি বিদেশি সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ভারতের জাতীয় দিবসে ওবামা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার ঘটনা একতা গুপ্তার মনে রেখাপাত করেছে। মোদির শৌচ ভারত অভিযান ও শিক্ষক দিবসের বক্তব্যেও তিনি আলোড়িত হয়েছেন।
২৯ বছর বয়স্কা এমএনসি পেশাজীবী শিল্পা শর্মা আম আদমি পার্টির সরকারকে 'অস্থিতিশীল পর্যায়' বলে অভিহিত করে প্রশ্ন রাখেন, একটা সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে কী হতো তখন? তখনও কেজরিওয়াল যে এ নিয়েও দোষারোপের রাজনীতি করবে না, তার নিশ্চয়তা কি দেওয়া যায়? দোষারোপের ভঙ্গিতে তিনি বলেন, কেজরিওয়াল দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায়। বারানসীতে যখন কেজরিওয়াল মোদির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যান তখনই তিনি যে দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তে দেশের প্রধানমন্ত্রী বনতে চান, সেটা এখানে অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
যারা মনে করেন, মোদি পাকিস্তানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো সাহস রাখেন এবং যারা মনে করেন, দেশের হিন্দু চরিত্রকে অস্বীকার করা হচ্ছে তাকে আবার যথাস্থানে স্থাপন করতে হবে, তাদের পক্ষে পছন্দ বাছাই করা অনেকটা সহজ। তবে বিজেপির মূল উদ্বেগের সঙ্গে যারা সহমত পোষণ করেন না তাদের পক্ষে পছন্দ বাছাই করাটা সহজ নয়। নির্মাণ কোম্পানির কর্মী মনোজ সিং মনে করেন, বস্তিতে বসবাসকারী মানুষকে হয়তো সম্মোহিত করা যাবে। তবে কেজরিওয়াল কোনো সমাধান দিতে পারেন না, তিনি কেবল দৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল দেখাতে পারেন ও ইউ-টার্ন মারতে পারেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রতি যে তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, তাই প্রমাণ করলেন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কোম্পানিতে কর্মরত পঙ্কজ সহায় প্রশ্ন রাখেন, ভর্তুকি দেওয়ার অর্থ আসবে কোথা থেকে? তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিল যদি হ্রাস করা হয় ও পানি যদি বিনা অর্থে দেওয়া হয়, তাহলে এর অর্থ তো কাউকে না কাউকে পরিশোধ করতে হবে।
স্পষ্টভাবেই বিভেদ অলঙ্ঘনীয় কিছু নয়। তবে পার্টিগুলো যেখানে শ্রেণীর ভিত্তিতে ভোট কাটবে, তাদের কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ বটে। এবারের নির্বাচনে আম আদমি পার্টি জিতুক আর বিজেপি জিতুক বিজয়ী দলকে যারা তাদের ভোট দিয়েছে এবং যারা ভোট দেয়নি তাদের সবার কাছে পেঁৗছাতে হবে। আম আদমি পার্টিকে অবশ্যই তার গরিব তুষ্টকারী নীতি টেকসই করার মতো অর্থনৈতিক নীতি নেই বলে যে ধারণা রয়েছে তা দূর করতে হবে। বিজেপি ধনীদের এবং ধনীদের জন্য পার্টি বলে যে ধারণা দিলি্লতে রয়েছে তাদেরও সেটা দূর করতে হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
ভারতীয় কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.