দিলি্ল তুমি কার? by সীমা চিস্তি

মুম্বাই ষাটের দশক পর্যন্ত শহুরে ভারতের মধ্যমণি ছিল। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত দিলি্ল হয়ে উঠেছে ভাগ্যান্বেষণকারী অভিবাসীদের কাঙ্ক্ষিত শহর। তবে এই ঐতিহাসিক শহরটি সবসময় ভারতের রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দিলি্লর প্রতীকী ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে 'দিলি্ল দুর অস্ত' ও 'চলো চলো দিলি্ল চলো'র মতো স্লোগানের মধ্যে। ষাটের দশকে সাধুরা এবং সত্তরের দশকে রামলীলা ময়দানে জরুরি অবস্থাবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ জাতীয় মনোভাবকে সেট করে দিয়েছিল। যারা ভাগ্যান্বেষণে এই শহরে আসেন তাদের নিজের ভাগ্য যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি তারা রাজনৈতিক পরিবর্তনেও অবদান রাখেন। অনেকে মনে করেন, এবার দিলি্লকে বিজেপি তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিয়েছে। এখানে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দিলি্লর রাজনৈতিক গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই নির্বাচন শহরের মানুষদেরও তাদের পছন্দের দল ও প্রার্থীকে বাছাই করার সুযোগ করে দিয়েছে।
ভারতের অন্য নগরগুলোর মধ্যে দিলি্লই একমাত্র শহর, যেখানে আঞ্চলিক সেন্টিমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়। আঞ্চলিক গর্ব জাগিয়ে তুলতে শিবসেনার মতো দলও এখানে নেই। ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় এই শহরে যে পাঞ্জাবি প্রাধান্য ছিল, সেটা কালের প্রবাহে ক্ষীয়মাণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের একটা মিশ্রণ তৈরি হয়েছে শহরটিতে। ভাষাগত বা আঞ্চলিকভাবে কোনো সম্প্রদায় এই শহরে তারাই শের বা একচ্ছত্র দাবি করা যায় না। এই শহর সব মানুষের।
ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ট্যালেন্ট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কাউকে প্রতিপালন করার ঐতিহ্য কংগ্রেসের না থাকলে অতি সম্প্রতি দলটি 'দিলি্ল মডেল' সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রে ১৫ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বিভিন্ন উপলক্ষে 'দিলি্লর সুলতানাত' আখ্যায়িত করে বিদ্রূপ করার চেষ্টা করতেন। এর মাধ্যমে তিনি বস্তুত দিলি্লর ক্ষমতা অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। আন্না হাজারে ও কেজরিওয়াল পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান দিলি্লতে শুরু হয়েছিল বলেই তা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়।
দিলি্ল একটি পরিপূর্ণ রাজ্য না হয়েও এখানকার নির্বাচনের এত গুরুত্ব কেন? কেনই-বা এই নির্বাচনকে ঘিরে এত উত্তেজনা? দিলি্লর সমৃদ্ধি দেশের অন্য রাজ্যগুলোর সঙ্গে এর পার্থক্য টেনে দিয়েছে। এনএসএসের গবেষণা অনুযায়ী জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ভারতের শীর্ষ ২০টি জেলার মধ্যে ১১টিই দিলি্লতে। এই সমৃদ্ধি প্রতি মাসেই হাজার হাজার মানুষকে এখানে আসতে প্রলুব্ধ করছে। ভারতের প্রথম চিরায়ত কর্মর্জীবী শহর মুম্বাইয়ের চেয়ে দিলি্লতে আগত অভিবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি। দেশের ২৯টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মানুষের যে যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিনিধিত্ব দিলি্লতে রয়েছে, তা কোনো রাজ্যেই নেই। তাই এই রাজ্যের নির্বাচনে জয়-পরাজয় রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক অর্থ বহন করে। কারণ সারা ভারতের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত এই রাজ্য নিজেই 'মিনি ভারত' হয়ে উঠেছে। এখানকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বর্ণ নির্বিশেষে এক ধরনের পরস্পর-নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে। গত বছরের ১৬ মে জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকেই দিলি্লর কংগ্রেস সরকারের লজ্জাকর পারফরম্যান্সের কারণে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দল যে গো-হারা হারবে, তা বোঝা যাচ্ছিল। যদিও সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার কমেছে তবুও তারা এ দুটি রাজ্যে অতীতের চেয়ে বেশি আসন লাভে সক্ষম হয়। তবে লোকসভা নির্বাচনে দিলি্লর ৭টি আসনেই জয়লাভ করার পর এবার এখানকার বিধানসভা নির্বাচনে দলটি পরাজিত হলে তা বেঢপভাবে মানুষের দৃষ্টিগোচর হবে ও বিজেপির জন্য বিব্রতকর হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মিলে গত আট মাসে অনুষ্ঠিত রাজ্য নির্বাচনগুলোতে বিজয়ের যে ধারা সৃষ্টি করেছেন, দিলি্লতে পরাজিত হলে ছন্দপতন হবে। আর বিজয়ী হলে এটাকে দেখা হবে দলের ঊধর্ে্ব নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটির বিজয় হিসেবে। দিলি্লতে দলের কিছু অংশের নেতৃবৃন্দকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে নতুন মুখকে দিলি্লর দলের মনোনীত মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করা হয়েছে। তবে ব্যাপকভাবে মনে হয় যে, দিলি্লর সম্ভাব্য পরাজয়কে আঁচ করতে পেরে রক্ষাকবচ নীতি হিসেবে কিরণ বেদিকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, মোদি নিজেই আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে এবার নির্বাচনে নেমেছেন। তাই দল পরাজিত হলে তার বিশ্বাসযোগ্যতাও ধাক্কা খাবে।
নরেন্দ্র সোদি-অমিত শাহ ব্র্যান্ডের রাজনীতিকে দিলি্লর নির্বাচন বিরাট পরীক্ষার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। আম আদমি পার্টি যেভাবে তাদের সাধারণ মানুষের স্বার্থের পতাকাবাহী দল হিসেবে পরিচিত করাচ্ছে; এই নির্বাচনে তারা বিজয়ী হলে বিজেপির খেটে খাওয়া মানুষের দল হয়ে ওঠার জিগির মার খাবে। এভাবে দলটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার প্রধান অস্ত্রটিই হারিয়ে বসতে পারে। বিজেপি সাধারণ মানুষের স্বার্থের পতাকা বহনকারী দল বলে বিপুলসংখ্যক ভোটার জনগণের আস্থা অর্জন করতে যদি না করতে পারে, তা হলে দলটির অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
বিজেপি নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়ার জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপই এখন পর্যন্ত নেয়নি। অধিক সংখ্যক রাজ্যে জয়লাভ করে তাদের মধ্যে একটা আত্মতুষ্টির ভাবজাত স্টাইল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে দিলি্লর নির্বাচনে পরাজয় ঘটলে তাতে তাদের 'বিপক্ষ-মুক্ত' প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিজেপি লোকসভায় তাদের শক্তিশালী নিরাপদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর জন্য তাদের অধ্যাদেশ জারি করতে হয়েছে_ সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। এ মাসের শেষদিকে যখন সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে, তখন বাজেট পাস করানোর ক্ষেত্রে বিজেপির দিলি্লর বিজয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তখন বিরোধীরা আরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে। কিন্তু যদি বিজেপি দিলি্লর নির্বাচনে পরাজিত হয় তাহলে বিরোধীরা, বিশেষ করে রাজ্যসভায় (সংসদের উচ্চকক্ষ) বাজেট নিয়ে হল্লা বাধাবে। তখন বিজেপিকে বাজেট পাসে তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য গলার স্বরটা নিচু করতে হবে।
দিলি্ল যেখানে এক সময় জনসংঘ ও বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি, বিকে মালহোত্রা ও লালকৃষ্ণ আদভানির মতো নেতাদের নির্বাচিত করেছে; সেখানে বিজেপির পরাজয় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে। বিজেপির এই অস্বস্তিতে কংগ্রেস হয়তো স্বস্তি অনুভব করতে পারে; কিন্তু আম আদমি পার্টির 'মিনি ভারত' বিজয় তাদের জন্যও উদ্বেগের বিষয়। কংগ্রেস যদি নিজেকে বিজেপির স্বাভাবিক বিকল্প হিসেবে ধরে নিয়ে থাকে এবং কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে সব বিরোধী দল আবর্তিত হবে মনে করে থাকে, সে ক্ষেত্রে আম আদমি পার্টির বিজয় তাদের এই ধারণার বেলুনের বাতাস কেড়ে নিতে পারে।
আম আদমি পার্টি হয়তো ইউরোপকে ঝাঁকুনি দানকারী সিরিজা অথবা পডিমোসদের মতো পার্টি নয়। কিন্তু দিলি্লতে আম আদমি পার্টির বিজয়, বিজেপি একমাত্র শহুরে ভারত, ভবিষ্যৎ ভারত বিনির্মাণে সক্ষম বলে যে ধারণা রয়েছে, তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
ভারতীয় সাংবাদিক
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.