দেশের মাটিতে প্রবাসীদের দুঃসহ যন্ত্রণা by রোকনুজ্জামান পিয়াস

ফ্লাইট রাত ১টায়। কিন্তু ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন একদিন বা দু’দিন আগেই। কেউ উঠেছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, কেউবা হোটেলে। আর যাদের সে সুযোগ নেই, তারা দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছেন বিমানবন্দরেই। কারণ তারা জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছেন বহির্বিশ্বে। পরিবারের সচ্ছলতা আনতে সেখানে যাচ্ছেন ঘাম ঝরানো শ্রম বিক্রি করতে। টানা অবরোধে আতঙ্ক, শঙ্কা নিয়ে তাই নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তারা। এতো দুর্ভোগ স্বীকার করা বিদেশ গমনেচ্ছু এসব মানুষের লক্ষ্য একটাই- যেন টানা অবরোধে স্বপ্নের ফ্লাইটটা মিস না হয়। সরজমিনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ ভাড়া। বিদেশ ফেরত অনেকে বাড়ি ফিরছেন বিমান ভাড়ার সমপরিমাণ গাড়ি ভাড়া দিয়ে। গত দু’দিনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, বিদেশ গমনেচ্ছু অনেকেই বিমানবন্দর এলাকার ভেতরে জটলা পাকিয়ে বসে আছেন। তাদের কেউ একা, আবার কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করছেন। টানা অবরোধে ফ্লাইট যেন মিস না হয়-সেজন্য তারা আগে থেকেই চলে এসেছেন। অনেকে একটি খবরের কাগজ বিছিয়েই রাত কাটিয়ে দিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। যাদের কারও ফ্লাইট ১২ ঘণ্টা, কারও ২৪ ঘণ্টা পর। তাদের বক্তব্য, টানা অবরোধের কারণে এলাকা থেকে নিয়মিত যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে আসছে না। মাঝে মাঝে দু-একদিন পরপর একটা-দুইটা বাস ছাড়ে। তখনই চলে আসতে হয়েছে। এরপর যদি সময়মতো বাস আর না পাওয়া যায়। অনেকে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বা এম্বুলেন্সে করে পৌঁছেছেন বিমানবন্দরে। তবে এজন্য ভাড়া গুণতে হয়েছে অনেক বেশি। তবে বেশি ভাড়া নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে চালকরা বলেন, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করছেন। অন্যদিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও শিডিউল ঠিক না থাকায় এবং ফিশপ্লেট তুলে ফেললে যাত্রা বাতিল বা বিরতিতে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারার আশঙ্কায় এ পথেও আসছেন না কেউ। ওমানগামী মাগুরা জেলার নৈহাটি গ্রামের পাখি মণ্ডল। তার ফ্লাইট ছিল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। মামা নিয়ামত আলীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান সোমবার ভোরে। ঢাকায় কোন আত্মীয়স্বজন না থাকায় গাবতলী থেকে সোজা চলে যান বিমানবন্দরে। বিমানে ওঠা পর্যন্ত বিমানবন্দরেই কাটান তারা। রাতভর হাটাহাটি, কখনও বা পত্রিকা বিছিয়ে চোখ বুজার চেষ্টা করেছেন। আর দিনে তো ঘুমানোর সুযোগই নেই। তাদের চেহারায় না ঘুমানোর ক্লান্তি ফুটে ওঠে। মামা নিয়ামত আলী জানান, এলাকা থেকে নিয়মিত বাস ছাড়ছে না। ওই দিন রাত একটার দিকে ছেড়েছে তাই চলে এসেছি। এর আগে যদি আর কোন বাস না ছাড়ে, এজন্য ঝুঁকি নেইনি দুবাইগামী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জাকিরের ফ্লাইট ছিল মঙ্গলবার রাত ৯টায়। কিন্তু তিনি ফ্লাইট ধরতে আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছান। রাতটুকু কাটিয়েছেন পার্শ্ববর্তী একটি হোটেলে। এরপর সারা দিন বিমানবন্দরের আশেপাশেই কাটান। তিনি বলেন, রাতের বেলা দু-একটি গাড়ি চললেও ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। তাই মাইক্রোবাসে করে ঢাকা আসেন। তিনি বলেন, চালক তার পরিচিত হওয়ায় ৯০০ টাকা নিলেও অন্যান্য যাত্রীর কাছ থেকে নিয়েছেন ৪-৫ হাজার করে। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের ইন্তাজ। কাজ নিয়ে তিনিও দুবাই যাচ্ছেন। তার ফ্লাইটও মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায়। বাসে করে ভোর বেলায় পৌঁছেছেন ঢাকায়। বলেন, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করতে পারেননি সারা রাত। প্রথমে ট্রেনে আসতে চেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, পরে মত বদলিয়েছেন কারণ ট্রেনে দুর্ঘটনা মানেই একটা দিন পার। ফ্লাইট মিস। কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার মো. এরশাদ সৌদি আরবের উদ্দেশে বাড়ি থেকে মাইক্রোবাসে করে রওনা দিয়েছিলেন বুধবার সকালে। পৌঁছেছেন দুপুর ১১টায়। তার ফ্লাইট রাত ১টায়। বিমানবন্দরের একটি গাছতলায় কখনও বসে, দাঁড়িয়ে আবার কখনও পায়চারী করে সময় পার করছেন। রাত একটা পর্যন্ত এভাবেই তাকে কাটাতে হয় তাকে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে আগেই চলে এসেছেন। বলেন, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরই হওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিক সময় হলে হয়তো বিকালে রওনা দিলেও হতো। টাঙ্গাইলের উপজেলার হোসেন আলী। তার ফ্লাইট ছিল বুধবার রাত ৯টায়। তিনিও বিমানবন্দরে পৌঁছান বেলা ১০টার দিকে। তিনি বলেন, সকাল ৮টায় কালিহাতী থেকে রওনা দিয়েছিলেন। হোসেন আলী জানান, পুরো রাস্তায় খুব আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। আসার পথে দু’টি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও দেখেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, পুলিশি পাহারায় নাকি গাড়ি চলবে শুনেছি, কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। এ সড়কে প্রচুর যানজট থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ দ্রুতই চলে এসেছি। রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। যে কয়েকটি বাস চলেছে তাতেও যাত্রী সংখ্যা খুব কম। এদিকে বাসের বিকল্প হিসেবে মানুষ যে যানবাহনগুলোতে আসছেন সেখানে তাদের গুণতে হচ্ছে অনেক বেশি টাকা। এমনকি যারা বিমানবন্দর ছেড়ে যাচ্ছেন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যেতে তাদেরও দ্বিগুণ বা তিনগুণের বেশি ভাড়া গুণতে হচ্ছে। গুলিস্তানের প্রাইভেট কার চালক আবদুর রাজ্জাক জানান, ভাড়াতো বেশি হবেই। কারণ চালকরা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি বের করছেন। একেবার অন্যেন্যপায় না হলে কেউ বের হন না। সিএনজি-অটোরিকশায় বিমানবন্দর থেকে গুলিস্তান যেতে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ভাড়া দিতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। আর প্রাইভেট কারের ভাড়া আরও বেশি। ঢাকার ভেতরে আড়াই থেকে ৩০০০ টাকাও নিচ্ছেন কেউ কেউ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বুধবার অ্যাম্বুলেন্সে করে যাত্রী নিয়ে এসেছিলেন চালক মোবারক। তিনি জানান, ৯০০০ টাকা চুক্তিতে তিনি বিদেশগামী একজনকে নিয়ে এসেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাসের ভাড়া কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৭০ টাকা। মোবারক জানান, ভাড়া বেশি হলেও যাতায়াতের জন্য মানুষ অ্যাম্বুলেন্সকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ মনে করে। তিনি জানান, এজন্য ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করি তাই ভাড়াও বেশি নিই। তিনি আরও জানান, গত দু’দিন আগে পাবনাতে ২২ হাজার টাকা ভাড়ায় এক যাত্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া অবরোধের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ভাড়া নিয়েছেন বলেও জানান। মোবারক বলেন, আতঙ্কের ভেতরেই রাস্তায় বের হই। যে কোন সময় বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ২৩ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি নষ্ট হয়ে গেলে তখন ক্ষতিপূরণ কে দেবে? অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সির চালকরা যেতেও রাজি হচ্ছে না। সিরাজগঞ্জে কত ভাড়া নেন জিজ্ঞেস করতেই এক চালক বলেন, অবরোধের পরে যোগাযোগ কইরেন। একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে নিরাপত্তা দেয়ার নামে মোড়ে মোড়ে পুলিশের চাঁদাবাজি। এতে করে ওইদিকে কেউ যেতে চায় না বলেও তারা জানান। অপরদিকে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালিত ট্যাক্সি ও মাইক্রোবাস সার্ভিসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি বলে জানিয়েছেন কাউন্টার সুপারভাইজার কামাল হোসেন। এখানে কোন গাড়ি ভাড়ায় গেলে রিসিট দেয়া হয়, তাই বেশি ভাড়া নেয়ার সুযোগ নেই। বাবা অটোগ্যাস, গ্রীণ বাংলা লিমোজি ও বিএম ট্রান্সপোর্ট নামে তিনটি কোম্পানির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তারা দুটি টার্মিনালের যাত্রীদের এ সার্ভিস দেন। কামাল আরও জানান, তাদের সার্ভিস অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কারণ কোন যাত্রীর গাড়িতে কোন জিনিসপত্র ভুলে গাড়িতে ফেলে গেলে পরে এখানে যোগাযোগ করে ফেরত পান। কিন্তু বাইরের ভাড়া গাড়িতে গেলে সে সুযোগ নেই।

No comments

Powered by Blogger.