‘হামার ছোলোক আনি দ্যাও’ by শাহাবুল শাহীন তোতা

(ছবি:-১ গাইবান্ধায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় নিহত সুমন মিয়ার বাবা শাহজাহান আলী। ছবি:-২ নিহত সুমনের মা মজিদা বেগম। ছবি: শাহাবুল শাহীন) ‘ছোলট্যা কামাই করব্যার জন্নে ঢাকাত যাবার ধরচিলো। কেটা হামার ছোলট্যাক মারি ফেলালো। হামরা একন ক্যামন করি চলমো। তোমরা হামার ছোলোক আনি দ্যাও। ’
আজ শনিবার দুপুরে এভাবেই আহাজারি করছিলেন পেট্রলবোমা হামলায় নিহত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের সুমন মিয়ার (২২) মা মজিদা বেগম। এ সময় সুমনের বাবা শাহজাহান আলী নির্বাক দাঁড়িয়েছিলেন।
গতকাল রাত ১১টার দিকে গাইবান্ধা শহরের অদূরে তুলসীঘাট এলাকায় গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় শিশুসহ ছয়জন প্রাণ হারায়। দগ্ধ হয় আরও ৪০ জন। নিহত লোকজনের সবার বাড়ি জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়।
আজ সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর, দক্ষিণ কালির খামার, মধ্যপাড়া খামার, পশ্চিম সীচা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নিহত লোকজনের পরিবারে মাতম চলছে।
নিহত সুমন ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। তিনি দুই সপ্তাহ আগে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। গতকাল নাপু পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সুমন সবার বড়। পাঁচ সদস্যের সংসারে একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
এ ঘটনায় নিহত দক্ষিণ কালির খামার গ্রামের দিনমজুর সৈয়দ আলীর (৪২) বৃদ্ধা মা সাবানা বেগম ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘হামার ছোলট্যা কি করচিলো বাবা। মানষে তাক মারি ফেলালো।’ এ পরিবারেরও একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন আলী। তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে শরিফা খাতুন দশম শ্রেণি, ছোট মেয়ে শান্তি আকতার ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছোট ছেলে ইমরান প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। কাজের সন্ধানে তিনি মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছিলেন।
নিহত শিশু শিল্পী রাণীর (৬) বাবা উপজেলার পশ্চিম চণ্ডীপুর গ্রামের বলরাম দাস ও মা সাধনা রাণী দিনমজুরের কাজ করেন। তাঁরাও কাজের সন্ধানে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছিলেন। পেট্রলবোমা হামলায় মেয়েকে হারিয়েছেন, তাঁরা দুজনও দগ্ধ হয়েছেন। এঁদের মধ্যে মা সাধনা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও বাবা বলরাম গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলরাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পেটের দায়ে রোজগারের জন্নে যাচ্ছিলাম বাবা। হামরা সবি হারানো। হামরা গরিব মানুষ, আজনিতি বুঝিনে। কামলার কাম করি খাই। হামরা কি অপরাদ করচিনো, হামার ছোলট্যাক কারি নিলো। ’
একই উপজেলার পশ্চিম সীচা গ্রামের দগ্ধ হালিমা বেগমের (৪০) বাড়িতে চলছিল মাতম। তাঁর মেয়ে শামসুন নাহার বলেন, ‘হামার মা পেটের জন্নে ঢাকাত যাবার ধরি মরি গেলো। তাঈ কী দোষ করচিলো। হামরা একন কাকে নিয়া বাঁচমো।’ ঢাকার একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন হালিমা। তাঁর বড় ছেলে সামছুল হক বিয়ে করে আলাদা থাকেন। একমাত্র মেয়ে শামসুন নাহারের বিয়ে হয়েছে। এক মাস আগে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। গতকাল রাতে নাতি সাজু মিয়াকে (২৫) সঙ্গে নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে তিনি পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যান। নাতি সাজু দগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন।

No comments

Powered by Blogger.