হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে by সৈয়দা পাপিয়া

সরকার নিয়ন্ত্রিত আদালত আরাফাত রহমান কোকোকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আল্লাহ এবং জনতার আদালতে আরাফাত রহমান কোকো বেকসুর খালাস পেয়েছেন কি না, সে প্রশ্নও তোলা যায়। জীবিত আরাফাত রহমান কোকোকে শুধু জিয়া পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে গ্রেফতার, কারাবরণ, কারাদণ্ড এবং নির্বাসন ভোগ করতে হয়েছে জীবদ্দশায়। মৃত আরাফাত রহমান কোকো সেই শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার বিষাক্ত থাবা থেকে রেহাই পাননি; কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে গুলশান অফিস, গুলশান অফিস থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং বায়তুল মোকররম মসজিদ থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের ঢল এটাই প্রমাণ করে যে, জনতার আদালত থেকে খালাস দিয়েছে আরাফাত রহমান কোকোকে। জনতার আদালত হৃদয়ের সব অনুভূতি ও সমর্থন জিয়া পরিবারের প্রতি দেখিয়েছে, এটা শাসক দলের ভাবার বিষয়। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেনÑ আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেন, কেউ শত চেষ্টা করলেও তাকে অসম্মান করতে পারে না। আল্লাহ যে সম্মান মর্যাদা আরাফাত রহমান কোকোর ভাগ্যে লিখে রেখেছেন, সেটা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দম্ভেও মুছে ফেলতে পারেনি। মানুষের ভালোবাসার অকুণ্ঠ সমর্থন, জনতার ঢল ও চোখের পানি দিয়ে কোকোর চিরবিদায় সরকারের কাছে একটি মেসেজ। এই গণবিস্ফোরণ সরকার কিভাবে নেবে জানি না। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, বার্ন ইউনিটে পোড়া মানুষের আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কেঁপেছে, না হলে ছেলে মরবে কেন? ছেলে কেন মরবে এ উত্তর আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারবেন না। তোফায়েল ভাইয়ের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন কারণে আমার শ্রদ্ধা ছিল; কিন্তু তার এই ‘মন্তব্য’ অজ্ঞ সখিনার মতো বলে মনে হয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনা হয়তো তোফায়েল আহমেদের জীবনে কখনো আসেনি। স্বজন হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণা সম্পর্কে অবগত আছেন আপনার নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ম খা আলমগীর, সালমান এফ রহমানসহ আপনার দলের অসংখ্য ব্যক্তি।
তোফায়েল ভাই ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়, এটা নিশ্চয়ই আপনার জানা। ১৫ আগস্ট অনাকাক্সিত দুঃখজনক ঘটনাও কি আপনার কথা মতো ‘আল্লাহর আরশ ভেঙে পড়া’, জেনারেল মইনউদ্দিনের অসুস্থতা কি আল্লাহর আরশ কাঁপা এবং সৈ¦রশাসকের কবলে পড়ে শাজাহান সিরাজ, দিপালী সাহা, বসুনিয়া, জিহাদ, ডা: মিলনের হত্যার পরেও কি মনে করেছিলেন যে, আল্লাহর আরশ কাঁপেনি কিংবা ভেঙে পড়েনি?
আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় লোকসমাগম দেখে আপনাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ, জিয়া পরিবারের জনসমর্থন আছে নাকি নেই। আপনারা বলে বেড়ান খালেদা জিয়ার জনসমর্থন নেই, আর সেটা আপনাদের দেখিয়ে দেয় ঢাকার জনগণ। হৃদয়ের টানে লাখ লাখ জনতার আওয়াজ আপনাদের মসনদ পর্যন্ত পৌঁছবে কি না জানি না। কথায় কথায় আপনাদের অনেক নেতা বলেন, আমাদের অনেকের সাথে নাকি আপনাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে, তারা কারা? তাদের তালিকা প্রকাশ করুন। তারা আপনাদের কাছে এ যাবৎ কী কী তথ্য ফাঁস করেছে, সেটাও জানতে চাই। এসব কথা বলে দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব-বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবেন না। কারণ আমাদের কাছেও তথ্য আছে আপনাদের অনেক এমপি-মন্ত্রীর পরিবার বিদেশে চলে গেছেন এবং অনেকেই পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে রেখেছেন বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য। অতএব আমাদের সম্পর্কে এসব কথা বলে কোনো লাভ হবে না। আপনার এমন মন্তব্যে বারবার আমার জানতে ইচ্ছে করে গুলশান অফিসে আপনার সেদিন আগমন শোকে মুহ্যমান ‘মা’ খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া, না অন্য কিছু? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গুলশান অফিসে যাওয়া গাড়ি থেকে কিয়ারেন্স ছাড়াই নেমে গেলেন। কে গেটে তালা মারল? কেন মারল? তালাতো অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় মারাই ছিল। নতুন করে কিভাবে তালা মারা হলোÑ কাকে বলেইবা আপনারা গেট পর্যন্ত গেলেন প্রধান মন্ত্রীর প্রটোকল তো কোনো সাধারণ মানুষের প্রাটোকল নয়। সবই প্রশ্নবিদ্ধ, শোকের সমবেদনা জানানোর আড়ালে কী রহস্য লুকিয়ে ছিল তা আমাদের কাছে শুধু নয়, দেশবাসীর কাছেও রহস্যজনক। কোকোর মৃত্যু আপনারা যে খাতেই প্রবাহিত করার চেষ্টা করুন না কেন এবং গুলশান অফিসে যাওয়া নিয়ে যত নাটক উপস্থাপন করুন না কেন, বাংলাদেশের মানুষ জিয়া পরিবারের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, সমর্থন, ভালোবাসা অকুণ্ঠচিত্তে ব্যক্ত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পর এটাই দ্বিতীয় বৃহত্তম নামাজে জানাজা। এভাবেই শত অত্যাচার, যন্ত্রণা, নির্যাতন, গুম, খুন, হত্যা এবং অপহরণসহ ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আজীবন বাংলাদেশের মানুষ জিয়া পরিবার তথা বিএনপির পাশে থাকবে, এটাই চিরন্তন সত্য। বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলে, মুজিবনগর থেকে জিয়ার মুরাল ভেঙে ফেলে, ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলে, শত শত মিথ্যা মামলা জিয়া পরিবার এবং দলের ওপর দায়ের করে, অবরুদ্ধ করে রাখা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা, মানুষের তার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসায় চিড় ধরানো সম্ভব নয়। এই চরম বাস্তব কথাটি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায় ততই দেশ জাতির ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল।
তোফায়েল আহমেদ অগ্নিদগ্ধদের নিয়ে যে নোংরা মন্তব্যটি করেছেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তাও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ জন্ম এবং মৃত্যুও একমাত্র সৃষ্টিকর্তার জানা, তোফায়েল আহমেদের নয়। তার এ ‘তথাকথিত মন্তব্য’ ষড়যন্ত্রেরই অংশ। পেট্রলবোমায় নিহত ব্যক্তিদের বিএনপির ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে দেশে বিদেশে বিএনপির বিরুদ্ধে বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা অপপ্রচারের এবং মিথ্যা মামলার তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের সব নেতাদের মামলার আসামি করা সুপরিকল্পিত ও নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র।
আপনাদের এ ছয় বছরের শাসন আমালে শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে, গুম হয়েছে ও হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। শীতলক্ষ্যা নদীতে মাঝে মধ্যে মরা মানুষের লাশ ভেসে উঠছে, সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে মৃত মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে ২০ জন আর ১৯ জনের কোনো সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না। একজনকে ক্রসফায়ার করে মারার পর কখনো বলা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে, কখনো বলা হচ্ছে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করাসহ উপরিউক্ত হত্যাকাণ্ডের যে সামান্য বিবরণ প্রদান করা হলো আপনি যেহেতু অন্তর্যামী, ভবিষ্যদ্বাণী করছেন জন্ম মৃত্যু নিয়েÑ আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন আপনাদের আমলে অসংখ্য অগণিত বর্বরোচিত নির্মম নিষ্ঠুর জীবন অবসানের জন্য খোদার আরশে কি মৃদু কম্পন হবে, না ভূমিকম্পের মতো কম্পন হবে, নাকি ভেঙে পড়বে?
লেখক :অ্যাডভোকেট ও সাবেক সংসদ সদস্য

No comments

Powered by Blogger.