বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা- মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি নয়

বুধবার ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিট পরিদর্শনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবরোধের আগুনে হতাহত ৬৩ জনের পরিবারকে যে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন, তা অসহায় ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে খানিকটা আশার আলো ও স্বস্তির সুবাতাস নিয়ে আসবে। নগদ অর্থের বদলে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র প্রদানের সিদ্ধান্তকেও আমরা সাধুবাদ জানাই। এর ফলে এই সহায়তা অপেক্ষাকৃত টেকসই হবে_ আশা করা যায়। কিন্তু সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হতে পারত দেশের সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষকে যদি বার্ন ইউনিটেই চিকিৎসার জন্য আসতে না হতো। বস্তুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯৯৩ সালে যখন দেশের প্রথম এবং পর্যায়ক্রমে আরও ১৪টি হাসপাতালে পৃথক বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ দুর্ঘটনাক্রমে দগ্ধ মানুষের চিকিৎসা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০১৩ সালের শেষদিকে এবং এ বছরের গোড়ায় ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক সহিংসতায় পেট্রোল বোমার ব্যবহার শুরু হলে 'রাজনৈতিক আগুনে' পোড়া রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে থাকে। আমাদের গ্রামাঞ্চলের কাঁচা ঘরবাড়ি এবং শহরাঞ্চলের বস্তি এলাকায় অগি্নকাণ্ডের অঘটন নতুন নয়। তবে এতে সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও হতাহতের সংখ্যা সাধারণত নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু পেট্রোল বোমা বা গান পাউডার দিয়ে যানবাহনে যে আগুন দেওয়া হয়, তার পরিণতি হয় এক কথায় ভয়াবহ। সেই ভয়াবহতা জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢামেক বার্ন ইউনিটের অবৈতনিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেনের বক্তব্যেই স্পষ্ট ছিল। তিনি বলেছিলেন_ 'রাজনৈতিক সহিংসতার সময় যানবাহনে দেওয়া আগুনে যারা পুড়ে যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেট্রোল বা গান পাউডারে পোড়ে। ফলে অনেক বেশি পুড়ে যায়। বিশেষ করে হাত বা পা অনেক সময় পুড়ে বিকৃত হয়ে যায়। সেগুলো আর সারিয়ে তোলা যায় না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তরাও অনেক সময় এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেন না। তাদের পোড়া মুখমণ্ডলের দিকে আপনজনও তাকাতে পারেন না।' গোটা পেশাজীবনে দগ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই_ এভাবে রাজনীতির নামে যেন জীবন্ত মানুষকে পোড়ানো না হয়। আগুনদাতারা যেন দগ্ধ মানুষের নারকীয় যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু নাশকতাকারীদের সুমতির অপেক্ষায় বসে থাকার অবকাশ নেই। তাতে পোড়া মানুষের অসহায়ত্ব আরও বাড়বে। আমরা চাই, দেশের ২৯টি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠা হোক। মানুষ পোড়ানোর হোতাদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই দগ্ধদের চিকিৎসায় যেন ত্রুটি না থাকে। সেক্ষেত্রে স্বস্তির খবর হচ্ছে যে, বার্ন ইউনিটের সংখ্যা, জনবল ও সরঞ্জাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে। পোড়া রোগীর চিকিৎসায় রাজধানীর মুগদাপাড়ার ৫শ' শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে ২০ শয্যার করে বার্ন ইউনিট চালু হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে পৃথক ইনস্টিটিউটে উন্নয়নের উদ্যোগও এগিয়ে গেছে। সেখানে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পোড়া চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকলেও অত্যাধুনিক সরঞ্জামের অভাবে দগ্ধ শ্বাসনালির নিরাময় সম্ভব হয় না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারেও ছয় কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। আমরা আশা করি, পোড়া চিকিৎসায় বাংলাদেশের সামর্থ্য সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। কিন্তু তাতে যেন কেবল দুর্ঘটনাক্রমে দগ্ধদেরই আসতে হয়; রাজনৈতিক সহিংসতার শিকারদের নয়। আর এজন্য নাগরিকদের প্রতি রাজনীতিকদের মমত্ববোধ ও দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.