আর কত পুড়ে মরা মানুষ চাই? by ড. নূরজাহান সরকার

আমার স্কুল শিক্ষক বিধু বাবু স্যার আমাদের অঙ্ক করাতেন আর বিজ্ঞান পড়াতেন। পড়া তো নয় যেন গল্প, অঙ্ক তো নয় যেন খেলা। এর প্রধান কারণ হলো তার বোঝানোর ক্ষমতা খুব উঁচু মানের। তা ছাড়া তিনি প্রতি কাসে একটি প্রাসঙ্গিক গল্প বলতেন। গল্পগুলোর বেশির ভাগই আজো আমার মনে আছে এবং আমার লেখালেখির মধ্যে বারবারই এসেছে। আজো তার একটি গল্প অবলম্বনে এ লেখাটি লিখছি। গল্পটি এমনÑ এক ইংরেজ সাহেব এ দেশে বহু দিন  থেকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বাংলা ভাষায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একদিন তিনি এবং তার এক বাঙালি বন্ধু নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তিনি তার বন্ধুটিকে বললেন, আমার যে শুধু ডিগ্রি হয়ে গেছে তা নয়, বাংলায় আমার আর অসুবিধা আছে বলেই মনে হয় না। বাঙালি বন্ধুটি বললেন, তাই? তাহলে এই মাঝিকে পাড়ে ভিড়াও তো দেখি। ইংরেজ বন্ধুটি বলতে থাকলো, ওহে কর্ণধার, তরী তটে সংলগ্ন কর, ওহে কর্ণধার, তরী তটে সংলগ্ন কর। কিন্তু মাঝি তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নৌকা বেয়েই চলছে। বাঙালি বন্ধুটি ইংরেজ বন্ধুটিকে বললেন, তুমি না বললে তোমার বাংলায় আর কোনো অসুবিধা নেই, তাহলে মাঝি পাড়ে আসে না কেন? ইংরেজ বন্ধু জবাব দিলেন, ও নির্ঘাত কানে শোনে না। তখন বাঙালি বন্ধু বললেন, তাহলে দেখ ও কানে শোনে কি না। বলেই মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এ্যাই ব্যাটা, নৌকা ভিড়া! আর অমনি মাঝি নৌকা নিয়ে পাড়ে চলে এলো।
এই গল্পটি আমার পাঠককে বলার একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটি হলো, আমার ধারণা আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের ভাষা বুঝতে পারছেন না। মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে, দেশ পুড়ে ছারখার হচ্ছে, রাজনীতিবিদেরা তা আমলে আনছেন না তো বটেই বরং একে অপরের দিকে দায় ছুড়ে দিচ্ছেন। জনগণ যখন যথাযথ ভাষায় কথা বলবে, তখন আর তাদের তা না শুনে উপায় থাকবে না। পরিশীলিত ভাষায় কথা না বুঝলে কী ভাষায় কথা বলতে হবে এ দেশের জনগণ তা জানে এবং আমার মনে হয় তার জন্য আর বেশি সময় নেই। মাতৃভাষার এ মাসে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে এ জাতি যথাযথ ভাষায় মাতৃভাষা রক্ষা করছে, যথাযথ ভাষায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
আমার শিক্ষক বিধু বাবু স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আগুনে পুড়ে মরা মানুষগুলোর জন্য আমার ভাষা আজ বোবা।হ
লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.