কিউবার পর ইরান : আমেরিকার সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে? by শাহির শাহিদ সালেস

কিউবার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত হোয়াইট হাউজের ঐতিহাসিক নীতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যেও একইভাবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বলে জল্পনাকল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইরান ও কিউবা উভয় সরকারের ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ কেন্দ্রীয় আদর্শগত স্তম্ভ হচ্ছে মার্কিন বিরোধিতা। কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটন উভয় দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন রেখেছে এবং প্রত্যেকের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে।
তত্ত্বগতভাবে দাবি করা হয় যে, ইরান অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতি কৌশল অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শত্রু দেশ হিসেবে গণ্য করে থাকে। ইরানের অভ্যন্তরীণ তথা দেশীয় অবস্থান অনুযায়ী এই  দৃষ্টিভঙ্গিÑ ইরানের জন্য উপকারী; কারণ এতে ইরান ভিন্ন মত দমন করতে পারবে এবং ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হবে।
আঞ্চলিকভাবে, এসব বিশ্লেষকের যুক্তি হলো, ইরানি নিজাম (রাজনৈতিক ব্যবস্থা) হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। আমেরিকার বিরোধিতা করলেই ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশটির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এমনকি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে এক দিকে রেখে গত ২৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইরানের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ইরান বিচার বিশ্লেষণ করেছে তাদের অন্য তিনজন প্রেসিডেন্টের অধীনে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে আমেরিকার সাথে আলাপ-আলোচনার পথ বা সুযোগ এসেছে। হাশেমী রাফসানজানি (১৯৮৯-১৯৯৭) তার শাসনামলে আমেরিকার তেল কোম্পানি কনোকোর সাথে ১০০ কোটি ডলারের (ডিএইচ ৩.৬৭ বিলিয়ন) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চুক্তির লক্ষ্য ছিলÑ দু’দেশের মধ্যকার তীব্র বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতির অবসান ঘটানো।
উল্লেখ্য, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ই দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ওই যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের প্রতি তার সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। সিআইএ’র ফাইল ও দলিলাদির বিবরণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানোর ব্যাপারে সহায়তা করে। রাফসানজানির কার্যক্রম বা তৎপরতা ওয়াশিংটনকে তখন থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপে প্রণোদিত করে।
মোহাম্মদ খাতামির প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন (১৯৯৭-২০০৫) সময়ে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে হামিদ কারজাইয়ের সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সেটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে এক্সিস অব ইভিল ‘শয়তানের কেন্দ্রবিন্দু’ বলে চিহ্নিত করেন। তথাপি ইরান ২০০৩ সালে অপর একটি চোখধাঁধানো উদাহরণ সৃষ্টি করে। ইরান তাদের সব বিরোধের অবসান ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘একটি গ্রান্ডবার্গেন ডিল’ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়। বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব পত্যাখ্যান করেছিল। এমনকি কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডন্ট আহমাদিনেজাদও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের জন্য যখন তিনি অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন, তখন তা ছিল নজিরবিহীন। কারণ, ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে বহু পর্যবেক্ষককে হতবুদ্ধি করে ফিরেছিলেন। এ ছাড়া আহমাদি নেজাদের অধীনে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপনে কয়েকবার আলাপ-আলোচনা শুরু করে। এ ধরনের উদাহরণ প্রমাণ করে যে, ‘শত্রু হিসেবে বর্ণনা’ করার তত্ত্ব বাস্তবতার সাথে মেলে না। কিন্তু এর অর্থ কয়েকজন বিশ্লেষক যুক্তি দেখান যে, ইরানের  পরমাণু ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধানকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তৈরির ব্যাপারে স্প্রিং বোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে কি চূড়ান্ত সমঝোতা হতে পারে? বাস্তবতা হচ্ছে, ইরানি নিজাম বা শাসকদের সর্বাধিক উদ্বেগের বিষয় নিরাপত্তা। তাই তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কম বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক চায়। যা-ই হোক না কেন, ইরান বেশ কয়েকটি কারণে স্বাভাবিক সম্পর্কের বিষয়টি নাকচ করে দেয়। সর্ব প্রথম হচ্ছে : যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ইরানি নেতৃত্ব বারবার গভীর অবিশ্বাস প্রকাশ করেছে। দেশটির আশঙ্কার ক্ষেত্রে দু’টি ফ্যাক্টর কাজ করেছে। প্রথমত, ইরানি সমাজবিজ্ঞানী আহমদ আশরাফের মত বজায় রাখেন বা রফা করেন ‘বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পারসিয়ানরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং তাদের সব ধরনের আদর্শিক অরিয়েন্টেশন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল, সেটা রাজনীতি ও ইতিহাসের মৌলিক সমঝোতা বা বোঝাপড়া।’ বৃহৎ শক্তিগুলো দেশের ব্যাপারে গোপনে হস্তক্ষেপ এবং বিশ্ব দর্শন সৃষ্টির জন্য দায়ী। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার প্রতি অবিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানে আমেরিকার সম্পৃক্ততা এবং ১৯৭৯ সালে তেহরানে দূতাবাস দখলের পর যেসব নথিপত্র সংগৃহীত হয়েছে সেগুলো। ওই সব নথিপত্র বা দলিল অনুসারে মার্কিন দূতাবাস গোয়েন্দাগিরিতে জড়িত ছিল এবং ইরানের নতুন সরকারের সদস্য ও সেনাবাহিনীর সাথেও তাদের গোপন সম্পর্ক ছিল।
আয়াতুল্লাহ খামেনি যুক্তি দেখান যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সম্পর্ক গড়ে তুললে আমেরিকারনদের ইরানে অনুপ্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দেবে এবং তাদের গোয়েন্দা এজেন্টদের ইরানে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে স্বাভাবিক করার অপর একটি কম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছেÑ ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ অথবা খামেনির মতে তাহাজোমি ফারহানজি। ইরানের প্রভাবশালী এলিটদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রাথমিকভাবে আমেরিকাভিত্তিক বিভিন্ন  ফারসি টেলিভিশন স্টেশনের মাধ্যমে বিশেষ বিবেচনায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর ধারণা রয়েছে। এসবের মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে যে, ইরানি যুবসমাজের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়ার জন্য উদার মূল্যবোধগুলোকে প্রমোট করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ইরানের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবকে হেয় করা হচ্ছে।
আমেরিকার রাজনৈতিক চিন্তাবিদ জোসেফ নই, যিনি ‘সফট পাওয়ার’ ধারণার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি বলেন, আমেরিকান সংস্কৃতি হচ্ছে মার্কিন ক্ষমতা কাঠামোর অন্যতম একটি স্তম্ভ। ইরানি নেতৃত্ব আশঙ্কা করছে যে, স্বাভাবিক  সম্পর্ক বাণিজ্য ও ব্যবসা সম্প্রসাণের পথ উন্মুক্ত করে দেবে এবং এভাবে হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানে দু’দেশের নাগরিকদের যাতায়াত বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশে পশ্চিমাকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতে পারে এবং ইরানের আদর্শিক ভিত্তিগত ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে পারে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে ইরানি নেতাদের মতামত হচ্ছেÑ আরো অনেক ইস্যু রয়েছে যেগুলোর কারণে দু’দেশের সম্পর্ক সন্দেহ সংশয়ের মধ্যে পড়তে পারে।
ইরানের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিপ্লব রফতানি করা। সরকার অবশ্য জোর দিয়ে বলছে যে, কথার ভিত্তিতেই নীতি প্রণয়ন করা হবে, অস্ত্রের দ্বারা নয়। ২০১৩ সালের ফারসি বই মিস্টার অ্যাম্বাসেডরে এক  দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী  জাভেদ জরিপ দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘পশ্চিমা শক্তি, বিশেষভাবে আমেরিকার সাথে আমাদের একটি মৌলিক সমস্যা আছে। আমরা দাবি করি যে, আমাদের একটি ভিউ পয়েন্ট বা মতামত আছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শন করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শৃঙ্খলা পরিবর্তন করতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘মালয়েশিয়া এ ধরনের সমস্যায় পড়ে না কেন? এর কারণহ হচ্ছে, মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ঘটাতে চায় না। ...আমার মতেÑ অবশ্যম্ভাবীভাবে এটা আমাদের  ঝুঁকির মধ্যে ফেলেনি। বরং এটা হচ্ছে একটি ক্ষমতার উৎস।’ জরিপ আরো বলেন, ‘আমিও মনে করি না ইরান এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। বিপ্লবী লক্ষ্য ছাড়া আঞ্চলিক শক্তি হওয়া যাবে না। অন্ততপক্ষে আমরা পাকিস্তানের মতো একটি দেশ হতে পারব।’
এরপরে প্রশ্ন ছিল কিভাবে এই ভিশন অর্জন করা যাবে? যেটা এমনকি একান্তভাবে ইরানের অত্যন্ত উদারপন্থীরাও মেনে নেবে। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য হয়তো পথ করে দেয়া যেতে পারে।
ইরানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো তাদের বিপ্লব রফতানি করা। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কি ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নেবে? এ কারণে হয়তো মার্কিন মিত্ররা বা এই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্র হুমকির মুখে পড়তে পারে। ২৮ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘ইরান একটি অত্যন্ত সফল আঞ্চলিক শক্তি হতে পারে। কিন্তু তাকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে চলতে হবে।’ এরপর ইরানের কৃত্রিম আচরণ বা বড়াইকে আমেরিকার আশাবাদের সাথে তুলনা করলে অথবা অন্তত এ ব্যাপারে ওবামার বক্তব্যের কথা স্মরণ করা যায়। অধিকন্তু, এটা মনে করা কঠিন যে, মার্কিন কংগ্রেসে যারা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরাইলপন্থী এবং ইরানি সরকারের  বিরোধী তারা কি ওবামা প্রশাসনের সাথে ইরানের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনকে সমর্থন করবে? প্রত্যেকেই নিজেদের কারণে ভালো সম্পর্ক চায়। যা-ই হোক না কেন, সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করতে হলে, দূতাবাস খোলার মতো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হলেÑ ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের পক্ষে মৌলিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসতে হবে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ সৃষ্টির সম্ভাবনা হয়তো অদূরভবিষ্যতে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। তিনি ইরানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়ে লেখালেখি করেন।
ভাষান্তর : এম কে বাশার

No comments

Powered by Blogger.