পৃথিবীর পথে বাংলা by রউফুল আলম

সংস্কৃতির মূলে থাকে ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ নিজেদের সহজে গোত্রভূত করেছে। একই ভাষার সংঘবদ্ধ মানুষের জীবনযাত্রা ও বিশ্বাস থেকে তৈরি হয়েছে সংস্কৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার আন্তঃযোগাযোগ যখন বেড়েছে, তখন অবশ্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। সংস্কৃতির এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল ধর্ম ও পুঁজি; সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে রাজনীতি। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সংস্কৃতির পরিবর্তনের সময় প্রথম আঘাত আসে ভাষায়। বাহান্নর আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর 'একুশ' পূর্ববাংলায় হয়ে ওঠে এক চেতনার নাম। আমাদের জাতীয় জীবনে সত্যিকার অর্থেই এক সর্বজনীন উৎসব এই 'একুশ'। বাংলার একুশ এখন আর বাঙালির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়ে ২০০০ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পালিত হতে থাকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে। এ কথা সত্য যে, মাতৃভাষা বাংলার সর্বস্তরের চর্চায় দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচল কখনোই কমেনি। বাংলা আঁকড়ে রাখায় আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের পশ্চাৎপদতার একটি ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় সবসময়ই। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, অনেক দেশই সর্বস্তরে মাতৃভাষা চর্চা করে উন্নত হয়েছে। আমাদের অপারগতা, আমরা সহজে মেনে নিয়ে সেটা দূর করার প্রবল প্রয়াসে কখনোই ব্রত হইনি। বাংলা ভাষা সম্পর্কে উইলিয়াম কেরির একটি মন্তব্য এখানে অনুপ্রেরণীয়। তিনি বলেছিলেন, 'আমি বিশেষরূপে উপলব্ধি করিয়াছি যে, ভারতীয় অপরাপর সমস্ত প্রাদেশিক ভাষা অপেক্ষা বাঙ্গলা ভাষা সর্ব্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ।' বাঙালির ওপর এখন দুই ভাষার প্রবল প্রভাব। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ও বাংলাদেশে ইংরেজি। বাংলা কতদূর টিকে থাকবে, সে প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক সমাজে এখনও কম নয়। এতদসত্ত্বেও বাংলার চর্চা কমে যায়নি। শুধু বাংলাদেশের তরুণরাই গত এক দশকে যে পরিমাণ বাংলা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটা সত্যিই অভাবনীয়। অনলাইনে ইংরেজি প্রতাপের মাঝেও বাংলা ধীরে ধীরে যেন আরও দৃঢ়ভাবে স্থান নিচ্ছে। এটাই আশাব্যঞ্জক। এই চর্চাকে অব্যাহত রাখলে বাংলা বিলীন হবে না কখনও। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কথা বারবার বলা হলেও সেখানেই উদাসীনতা বেশি দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংবলিত তথ্যাদি আমরা পৃথিবীতে এখনও ছড়িয়ে দিতে পারিনি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় সে ইতিহাস লিখে আমাদেরই পেঁৗছে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে পৃথিবীর সেরা বইগুলো। তাহলে শিক্ষার্থীরা মনোবল পাবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইত্যাকার উদ্যোগ নেওয়া কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। আমাদের জাতীয় জীবনে রাজনীতির যতই উত্থান-পতন হোক না কেন, এখনও যে জাতীয়তাবোধ জেগে আছে, তার আধার এই ভাষা। সুতরাং বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। খুব ভালোভাবেই। বাংলা বেঁচে থাকলে আমাদের জাতীয়তাবোধও বেঁচে থাকবে। পৃথিবীর পথে আমরা দিতে পারব দীর্ঘ পথ পাড়ি।
ডক্টরাল গবেষক, স্টকহোম
বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন

No comments

Powered by Blogger.