বিরোধী দলের প্রশংসা, বাধাহীন বিল পাস by হারুন আল রশীদ

‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম জাতীয় সংসদের এক বছর কেটে গেছে। এ সংসদে বিরোধী দল সরকারের যতটা না সমালোচনা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে প্রশংসা। বরং সরকারের বেশি সমালোচনা করেছেন কয়েকজন স্বতন্ত্র সাংসদ। বিল পাসের ক্ষেত্রেও কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। এক বছরে সরকারি ও বিরোধী দলকে বড় ধরনের কোনো বিতর্কে জড়াতে দেখা যায়নি। দুটি দলই বরং সংসদের বাইরে থাকা দল বিএনপির সমালোচনায় ব্যস্ত ছিল। ৩৫০ সাংসদের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পর্ব, জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত বিষয়ে নোটিশ দিয়ে সংসদকে প্রাণবন্ত রেখেছেন দেড় শ জনের মতো সাংসদ। মন্ত্রী ও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংসদ ছাড়া অন্যরা সংসদীয় কর্মকাণ্ডে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এক বছরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এবারের সংসদ গত কয়েকটি সংসদের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। কারণ, বিরোধী দল নিয়মিত অংশ নিচ্ছে এবং সংসদীয় কাজে ভূমিকাও রাখছে। বিল পাসের ক্ষেত্রে তাঁরা নিয়মিত নোটিশ দিচ্ছেন। ফলে এবারের সংসদে যথেষ্ট সময় নিয়ে বিল পাস হচ্ছে।
প্রশ্নবিদ্ধ বিরোধী দল: জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। মন্ত্রিসভায় আছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মসিউর রহমান ও মুজিবুল হক। বিরোধী দল সরকারে কেন? এ প্রশ্ন একাধিকবার তুলেছেন স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি সেলিমসহ আরও কয়েকজন। তাঁরা জাপাকে কাগুজে বিরোধী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের বিতর্কে বিরোধী দলের পক্ষে কথা বলেছেন সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ সাংসদেরা।
এই সংসদে সরকারি দলের কর্মকাণ্ডে বিরোধী দল কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। চলতি অধিবেশনে বিএনপির কর্মকাণ্ডের সমালোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। তিনি দেশজুড়ে বিএনপির কর্মসূচিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যায়িত করে তা শক্ত হাতে দমনের আহ্বান জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি দল ও বিরোধী দলের একাধিক নেতা একই সুরে কথা বলেছেন।
বাধাহীন আইন পাস: বর্তমান সংসদে এখন পর্যন্ত ২২টি বিল পাস হয়েছে। বিল পাস নিয়ে সরকারি দলকে প্রধান বিরোধী দলের চেয়ে বেশি বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে স্বতন্ত্র সাংসদদের। এমনকি বিলের ওপর সংশোধনী নোটিশও বেশি দিয়েছেন স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী ও হাজি সেলিম।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস হয়। এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে আসা হয়। বাতিল হয়ে যায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সংসদের বাইরের বিরোধী দল ও আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই সংশোধনীর সমালোচনা করেছেন। বিরোধী দল তাদের সংসদীয় দলের বৈঠকে সংবিধান সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত সমর্থনই জানিয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের নীতি সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা এবং মন্দ কাজের নিন্দা করা। অযথা সংসদ বর্জন করে সংসদকে আমরা অকার্যকর করতে চাই না।’
তবে সংসদবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভায় থেকে বিরোধী দল সাজা যায় না; বরং আওয়ামী লীগ ঘরানার নেতা হওয়া সত্ত্বেও স্বতন্ত্র সাংসদেরা সত্যিকার বিরোধী দলের মতো কাজ করছেন।
কমিটিতে মন্ত্রীদের দাপট: সংসদ সচিবালয় কমিটি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এবারের সংসদীয় কমিটিগুলোর বেশির ভাগ সভাপতি মন্ত্রীদের ব্যক্তিত্বের সামনে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০টি সংসদীয় কমিটির ২৯৭টি বৈঠক হয়েছে। সর্বাধিক ১৬টি বৈঠক করেছে সরকারি হিসাব কমিটি। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ১১টি বৈঠক করেছে। মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ১০টি বৈঠক করেছে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং নয়টি করে বৈঠক করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক-গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি। একটি বৈঠকও করেনি পিটিশন কমিটি, বিশেষ অধিকার, কার্যপ্রণালিবিধি ও বেসরকারি সদস্যদের বিল-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
এবারের সংসদের অন্যতম আলোচিত বিষয় কয়েকটি কমিটির বৈঠকে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি। এ নিয়ে কমিটির বৈঠকে সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংসদ সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির আটটি বৈঠকের মধ্যে মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন চার দিন। শিল্প মন্ত্রণালয় কমিটির ছয়টি বৈঠকের মধ্যে মন্ত্রী আমির হোসেন আমু উপস্থিত ছিলেন তিন দিন। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ছয়টি বৈঠকের মধ্যে ছিলেন তিনটিতে।
বর্তমান মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া বিগত সরকারের নয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। এঁদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে।
বিশেষজ্ঞ ও সংসদ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সাবেক মন্ত্রীরা তাঁদের বিরুদ্ধে কমিটিতে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে সভাপতি হিসেবে তাঁরা সে-সম্পর্কিত তদন্তকাজকে প্রভাবিত করতে পারেন।
শেষ পর্যন্ত এই আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্ট নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে সংসদীয় কমিটি অভিযুক্ত সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদস্যদের কেউ কেউ বলছেন, তিনি কমিটির সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে কীভাবে অভিযোগ আনা যায়।

No comments

Powered by Blogger.