গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড  বন্ধ করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হংকং ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। গতকাল নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে বেড়েছে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত ৫ই জানুয়ারি থেকে ২৭শে জানুয়ারির মধ্যে দুই নারী ও সাতজন পুরুষসহ কমপক্ষে ৯ জনকে গুম করা হয়েছে। এসব মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ, র‌্যাব ও যৌথবাহিনীর সদস্যরা। এরপরই ওইসব মানুষ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করার আগে বেশ কিছুদিন ধরে তারা নিখোঁজ ছিলেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের বক্তব্যে এসব হত্যাকাণ্ডের পর বলছে, অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের সময় মারা গেছে ওইসব লোক। নিহত এই ৯ জন ছাড়াও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানতে পেরেছে যে, অন্য ৭ জনকে জানুয়ারি মাসে তুলে নিয়ে গেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তারা কোথায় বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত কেউ তা জানতেন না। ওইসব ব্যক্তিকে বানোয়াট মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছে। ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এখনও যারা নিখোঁজ রয়েছেন তারা হলেন- আল আমিন কবির (৩৫), মিসেস বিউটি বেগম (৩২) ও মিস মৌসুমী বেগম (৩০)। গত ১৪ই জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার চিতলি দক্ষিণপাড়ার বাড়ি থেকে যৌথবাহিনী ধরে নিয়ে যায় বিউটির স্বামী আল আমিন কবিরকে। এর এক ঘণ্টা পরে স্থানীয় পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বিউটি ও মৌসুমীকে। গ্রেপ্তারের সময় জনসমক্ষে নৃশংস নির্যাতন করা হয় আল আমিনকে। ওই দম্পতি ও তাদের গৃহকর্মী কোথায় তা এখনও রয়েছে অজানা। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন আরও বলেছে, প্রায় এক সপ্তাহ আগে, আল আমিনের দু’সন্তান ও তার মা মিসেস মাতোয়ারা বেগম রংপুর শহরে র‌্যাব অফিসে যান। এ সময় আল আমিন, বিউটি ও মৌসুমীকে গ্রেপ্তার ও আটক করার অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করে র‌্যাব। এক কর্মকর্তা ওই দু’ সন্তানকে বাড়ি চলে যেতে বলেন। তিনি বলেন, তোমাদের পিতামাতা ভিতরে আছেন। দু’সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে, এই তিন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের কোন আদালতে তোলা হয়নি। তাদের জীবন ও মর্যাদা নিয়ে উদ্বিগ্ন আত্মীয়-পরিজন। ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জেলে নারীদের ধর্ষণ করার ‘সুখ্যাতি’ রয়েছে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। যখন তারা কোন পুরুষ সদস্যকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় তখনই তারা পরিবারের নারী সদস্যদের আটক করে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নারী স্বজনরা এখন বাংলাদেশে জেলের ঝুঁকিতে রয়েছেন। নারীদের এভাবে খেয়ালখুশিমতো আটক ও গুমের ঘটনায় সমাজে চরম ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। যেসব নারীকে আটক ও গুম করা হচ্ছে তাদের অপরাধে জড়িত থাকার কোন রেকর্ড নেই বলে দাবি করছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। পদস্থ রাজনৈতিক কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা অস্বীকার করা সত্ত্বেও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ২৫শে জানুয়ারি র‌্যাব’র মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশে কোন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না। বেনজীর আহমেদ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অস্ত্র দেয়া হয়েছে কেন? হা-ডু-ডু খেলার জন্য, না ডাঙ্গুলি খেলার জন্য? অস্ত্র দিয়ে কি করা হবে? এসব বিপজ্জনক জিনিস, এতে মানুষ মরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পুলিশকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে মানুষ মারার জন্য। যদি সমস্যা হয় তখন নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করবে, গুলি করলে কি হবে? নিশ্চয় কিছু মানুষ মারা যেতে পারে! একটি সংঘবদ্ধ চক্র দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা জনগণের সাহায্য নিয়ে শান্তি স্থাপন করার চেষ্টা করছি। র‌্যাব’র ডিজি এর আগে বসনিয়া ও কসোভোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি শীতল বার্তা দিয়েছেন। বেনজীর আইনি কাঠামোর প্রতিই কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাননি, তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, যার কাছেই একটি বন্দুক থাকবে, তারাই যেন নিজের ইচ্ছা মোতাবেক হত্যা করার অধিকার রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের এ ধরনের মনোভাব বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে পরিণত করেছে, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এমন উন্মত্ততা একাধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সর্বনাশের কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নির্দেশ দেয়ার জন্য তিনিই দায়ী। বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করা একটি দেশ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা বন্ধে সরকারের ব্যর্থতার জন্য অদূর ভবিষ্যতে পরিণতি ভোগ করতে হবে দায়ীদের।

No comments

Powered by Blogger.