রাজশাহীতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কলেজশিক্ষক নিহত

রাজশাহীতে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক নুরুল ইসলাম শাহীন (৪৫) নামে এক কলেজশিক্ষক ও জামায়াত নেতা নিহত হয়েছেন। গতকাল সকালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পেয়েছে স্বজনরা। নিহত নুরুল ইসলাম শাহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার ইসলামীয়া কলেজে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রেস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই নেতা। তার পৈতৃক বাড়ি বিনোদপুর এলাকায়। তবে নগরীর হেতেম খাঁ এলাকায় তার শ্বশুর বাড়ির পাশে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনদের আহজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে নিহতের বিনোদপুর এলাকার  পৈতৃক বাড়িটি। পুত্র হারানোর শোকে কাতর পিতা আবদুর রহমান মুন্সীকে সান্ত্ব্তনা দিতে আসা প্রতিবেশীরও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। অন্যদিকে রামেক হাসপাতাল মর্গে নুরুল ইসলামের লাশ নিতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ছোটভাই ফজলুল হক তুহিন। নিহত শাহীনের স্ত্রী মাসুমা রাব্বী শোকে হতবিহ্বল। কোলের এক বছরের শিশু রাহিন ও ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া জাহিনকে (৮) নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন? তাদের পিতা হত্যার বিচারই বা কাদের কাছে দাবি করবেন? মহানগর জামায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাশেম জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন এভাবে একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এর প্রতিবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের অসহায় মানুষ তাহলে কাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন এই প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে। নিহতের শ্বশুর মোস্তাক আহমেদ মানবজমিনকে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর শাহীনের সাথে তার শেষ কথা হয়। ওর কাজের চাপের কারণে সেভাবে দেখা হতো না। রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর মালোপাড়া এলাকায় তার মালিকানাধীন পদ্মা অফসেট নামের একটি প্রেস থেকে ডিবি পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে প্রেসের কর্মচারীরা তাকে মোবাইলে জানান। এরপর তার দুই ছেলে ডিবি অফিসে গিয়ে দেখা করে আসে। সে সময় ডিবি কর্মকর্তারা বলেছিলেন শাহীনকে সকালে কোর্টে চালান দেয়া হবে। কিন্তু সকালে তার খোঁজ নিতে গিয়ে ডিবি পুলিশ রাজশাহী মেডিক্যালে যেতে বলেন। এটা ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করে বলেন, তার জামাইয়ের মতো সৎ মানুষকে এভাবে হত্যা- কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। তিনি এর বিচার চান। রামেক হাসপাতাল পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই বদিউজ্জামান জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৪টার দিকে তাকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি মাথায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ ছিলেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন চিকিৎসক। বর্তমানে ওই জামায়াত নেতার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়েছে। এদিকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, রাত ১১টার দিকে নগরীর মালোপাড়া এলাকা থেকে জামায়াত-শিবির ক্যাডার, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নুরুল ইসলাম শাহীনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি মতিহার ও বোয়ালিয়া থানার ৮টি ওয়ারেন্টভুক্ত ও  ১৩টি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। পরে মতিহার থানার ওসি’র ওপর হামলার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তার সহযোগী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা ও মতিহার পুলিশ রাত সোয়া ২টার দিকে নলখোলা আশরাফের মোড়ে পৌঁছালে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা নুরুল ইসলামের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ককটেল চার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে নুরুল ইসলাম পালাতে গিয়ে উভয়পক্ষের মাঝে পড়ে গুরুতর আহত হন। তাকে দ্রুত রামেক হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি আরও দাবি করেন, শিবিরের ছোড়া ককটেলের স্প্লিন্টারে ডিবি পুলিশের দুই কনস্টেবল আহত হয়েছে। তাদেরকে পুলিশলাইন হাসাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীদের ব্যবহৃত ১টি রিভলবার, ১০টি ককটেল ও ৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে আহত পুলিশ সদস্য বা উদ্ধারকৃত অস্ত্রের কোন ছবি বা ভিডিও ফুটেজ দিতে রাজি হননি পুলিশ কমিশনার।
শিবিরের প্রতিবাদ: নুরুল ইসলাম শাহীন নিহতের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাবি শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শোয়েব শাহরিয়ার। তারা এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে আইনের শাসন বজায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার উদাত্ত আহ্বান জানান। তা না করা হলে ছাত্রশিবির ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন। বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী মহানগরীর ৩০ নং ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি, ইসলামিয়া কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক, পদ্মা অফসেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম শাহীনকে মঙ্গলবার রাত ৮টায় মালোপাড়ায় অবস্থিত প্রেস থেকে ডিবি পুলিশের একটি টিম আটক করে নিয়ে যায়। এই সংবাদ  পেয়ে তার পরিবারের সদস্যরা মহানগর ডিবি অফিসে গিয়ে গ্রেপ্তারের সংবাদ নিশ্চিত হয়ে বাড়ি ফেরেন। এরপর একই রাত আনুমানিক ২ টার সময় পুলিশ ও যৌথবাহিনী খড়খড়ী বাইপাসের আশরাফের মোড় এলাকায় নিয়ে তাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং বন্ধুকযুদ্ধ হয় বলে এলাকাবাসীকে শাসিয়ে আসে। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ কাউকে সাক্ষী হতে নিষেধ করে আসে পুলিশ। পরে তাকে ভোররাত ৪টায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়। এ ঘটনা এবং পূর্ব-ঘোষিত ৪৮ ঘণ্টার হরতালের সমর্থনে নগরীর তালাইমারীতে রাবি শিবিরের প্ল্যানিং সম্পাদক সুমন রেজা, তথ্য সম্পাদক, প্রযুক্তি সম্পাদক এবং ফাউন্ডেশন সম্পাদকের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে রাবি শিবির।

No comments

Powered by Blogger.