সংবিধান সংশোধন হালকাভাবে কলম চালানোর বিষয় নয় -সংবিধানবিষয়ক স্মারক বক্তৃতায় ড. কামাল

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে গতকাল বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন আয়োজিত সংবিধান নিয়ে স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার পর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাত থেকে ক্রেস্ট নেন সুলতানা কামাল। মাঝে ড. কামাল হোসেন, পাশে অধ্যাপক শাহ আলম l প্রথম আলো) ‘সংবিধান অবশ্যই সংশোধন করা যায়। সেই বিধানও সংবিধানে আছে। কিন্তু এটি হালকাভাবে কলম চালানোর বিষয় নয়। এই সংবিধানের জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। বহু মানুষের বহুদিনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের সংবিধান পেয়েছি। কাজেই এর সংশোধন করার জন্য সবার মতামত নেওয়া অপরিহার্য।’
গতকাল বুধবার সংবিধানবিষয়ক স্মারক বক্তৃতার আলোচনাপর্বে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন এই মন্তব্য করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন এই স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। স্মারক বক্তৃতা দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেন আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলম, অধ্যাপক এম এম আকাশ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ কাজী জাহিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের সভাপতি আহমেদ জাভেদ।
স্মারক বক্তৃতায় সুলতানা কামাল বলেন, আজকের সংবিধান নিয়ে কথা বলতে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধনীর কাটাছেঁড়ায় এর আসল চেহারা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কামাল হোসেন বলেন, ‘যেনতেনভাবে এই সংবিধান আসেনি। স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও দেশের মাটি থেকে উঠে আসা যে মূল্যবোধ, লক্ষ্য, আদর্শ তা গ্রহণ করেই আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। এ পর্যন্ত সংবিধানের ১৬টি সংশোধন হয়েছে, কিন্তু একেবারে এটিকে বাতিল করা হয়নি। গত ৪৩ বছর আমরা এই সংবিধান ধরে রেখেছি এটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘বলা হয়েছে জনগণই ক্ষমতার মালিক। কিন্তু গত ৪৩ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের আগে জনমত যাচাইয়ের যে বিধান আছে, তা যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে জনগণের মতামত জানার আগ্রহ দেখানো হয়নি। ফলে সংবিধানে একই সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো অনেক গোঁজামিল রয়ে গেছে। এসব গোঁজামিল মুক্ত করতে হলে লেগে থাকতে হবে।’
স্মারক বক্তৃতায় সুলতানা কামাল সংবিধানের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য, সংশোধনী এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘৭২ সালে যে সংবিধান পেলাম, তা ১৯৫২ থেকে এ দেশের মানুষের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সেখান থেকেই এসেছে সংবিধানের চার মূলনীতি। পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে উড়িয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্রকে নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে সংবিধানকে সংকুচিত করা হয়। অষ্টম সংশোধনীতে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। ফলে রাষ্ট্র যে সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীল চরিত্র ধারণ করল তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টিতে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া হয়নি। সংশোধনীর অনেকগুলো বিষয়ই পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবার স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে সবার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার দলিল হিসেবে সংবিধানের যে শক্তিশালী রূপটি পেতে চেয়েছি, তাকে খণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে।’
আলোচকেরা বলেন, অনেক সংশোধনীর পরে বর্তমানে সংবিধান যে অবস্থায় রয়েছে তা ১৯৭২-এর সংবিধানের সবচেয়ে কাছাকাছি। তবে আরও কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘সংবিধানের কতটি সংশোধনী ব্যক্তির প্রয়োজনে আর কতটি জাতীয় প্রয়োজনে হয়েছে, কোথায় কী সংশোধন করছি, কেন করছি এসব বিষয় ভাবতে হবে। তবে আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসহ অনেক বিষয় আছে গর্বিত হওয়ার মতো। গোঁজামিলগুলোকে দূর করে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.