অবরোধ, অসংযম ও আন্দোলন নিয়ে দু’টি কথা by নয়ন বাঙ্গালী

মানুষ শুধু ব্যবহৃত পুতুল যখন রাষ্ট্রতন্ত্র তার মন্ত্রতন্ত্র নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ করে আর প্রতিবাদকে বিনাবিচারে সাজা দিয়ে মুখ স্তব্ধ করে দিতে চায়। পতনের ঘণ্টা আপনা আপনি বাজতে থাকে। প্রকৃতি নিঃসঙ্কোচে কিছু প্রতিশোধ নেয় যার প্রতিরোধ দুঃসাধ্য। দীর্ঘ দিন বিরোধী সংগঠনগুলোকে খাটো করার জন্য এমন এক ভয়ঙ্করী খেলা খেলেছিল। আন্দোলনের সার্থকতা কোথায় বা কিভাবে করলে সবাই বলবে চরম আন্দোলন হয়েছে, তার পরিমাণের ব্যারোমিটার আছে কি না জানি না। এতটুকু বলতে পারব যে, আন্দোলন মানেই প্রতিরোধ-প্রতিবাদ-অবরোধ-মিছিল-হরতাল-স্তব্ধ আর এগুলো সরকার প্রতিহত করতে চাইলে তা সহিংসতায় মোড় নেয়। তবুও বলা হচ্ছে আন্দোলন ব্যর্থ। আর কত মায়ের বুক খালি হলে আর কত গাড়ি পুড়ে ছাই হলে বলবে, আন্দোলন সফল। তাই এই পথে হাঁটার উসকানিদাতা সরকার বললে অত্যুক্তি হয় না। আন্দোলনটা বর্তমান সময়ের নিরিখে রাজনীতির স্বার্থে প্রয়োজন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। সরকার এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে নগ্নভাবে। সরকার জানে যে, জনগণ শত বিপদে থাকলেও বিশৃঙ্খলা চায় না, যারা আন্দোলনমুখী মানুষ তারা চিন্তা করে, আমাদের সংগ্রাম ভিনদেশী কোনো মানুষের সাথে নয় যে, প্রতিদিন গুলি করে মেরে ফেলতে পারলে ভালো লাগবে।  এ ছাড়াও বর্তমান প্রেক্ষাপটে লোকজন অনেকে আত্মকেন্দ্রিক, সম্পদ অর্জন ও নিরাপদ জীবনযাপনে আগ্রহী, সরকার এই দুর্বলতাকেও পুঁজি করে আন্দোলনের দায় প্রতিবাদী দলদের দিতে চাচ্ছে। দিবালোকে পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে বালুর ট্রাক দিয়ে রাস্তা অবরুদ্ধ করে, গেটে তালা লাগিয়ে বলে বেড়াচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় অফিসে রাত কাটাচ্ছে আর সব মানুষ তা বিশ্বাস করবে? কেন এত বেকুব ভাবে সাধারণ মানুষকে? এমনকি যারা কথায় কথায় অন্য দলের প্রধান নেতাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, অশিক্ষিত, ওয়ান্টেড আসামি ইত্যাদি বলেন, তাতে মানুষের মধ্যে কতটা জিদ সৃষ্টি হচ্ছে তা সরকার অনুধাবন করতে পারছে না। প্রায় দুই সপ্তাহ অফিসবন্দী একজন বিখ্যাত নেত্রী। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ক্ষমতাধর অত্যাচারীর পতন হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট ইস্যুতে। এখন সরকার তার রাজনৈতিক পরীক্ষায় টিকে থাকার জন্য কী কী করতে পারে তা দেখার বিষয়। বিএনপি সংলাপ চাচ্ছে সেই সংলাপের সুযোগ করে দিলেও অনেকটা সময় সরকার পেত। এ ধরনের কিছু মার্জিত কৌশল নিতে পারে। কিন্তু তা না করে সরকারের লোকজন যা বলে চার হাজার কোটি টাকা কিছু না; ঘুষ বৈধ, বিসিএসে ছাত্রলীগকে সুযোগ করে দিয়েছে, বালুর ট্রাক এনেছে খালেদা জিয়া বাড়ি বানানোর জন্য। এ ধরনের অবান্তর কাণ্ড করে দেশকে হাসির পাত্র করে তুলেছেন বিশ্বের মানুষের কাছে। বহির্বিশ্বেও বার বার নিজেদের নিজেরা জঙ্গি বানিয়ে, বিদেশী মেহমানদের দুইআনার মন্ত্রী বলে ছোট করে নিজের দেশকে খাটো করেছেন। জনগণ কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে কালো বিড়ালের টাকা বিডিআরের গেটে পাওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই ভুলে যায়নি। বিএনপির বিষয়ে বলতে পারি যে, বিএনপি এই দমনপীড়নে অভিজ্ঞতায় যা শিখেছে তাতে ক্ষমতায় গেলে অনেক সুন্দরভাবে চালাবে। অনেকে বলে যে, প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের আগুন এমন যে, আওয়ামী লীগ হয়তো ক্ষমতায় হারলে কেউ দেশে থাকবে না। হ্যাঁ ভুল স্বীকার করে পালিয়ে গেলে ভিন্ন কথা। বিএনপি মনে হয় না আওয়ামী লীগের মতো ভুল করে। মানুষ আর এই পাল্টাপাল্টি কাজ করে সময় নষ্ট করতে চায় না। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে চায়। প্রচুর মানুষকে বিদেশে পাঠাতে হবে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য অপেক্ষায় আছে খালেদা জিয়ার জন্য। খালেদা জিয়ার ওপর যে অত্যাচার হচ্ছে তার পুরো চিত্র বিশ্ববাসী জানে। তিনি এই অবরুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে পরিচিতি পেয়ে যেতে পারেন অং সান সু কির মতো। যেভাবে অবরোধ চলছে তা কমপক্ষে ৯০ দিন একনাগাড়ে চালিয়ে যাওয়া উচিত। কত দিন পুলিশ পাহারায় কার যানবাহন চালাবে এবং বিবেকবান সবাই বলতে বাধ্য হবে, আমাদের আর এভাবে ব্যবহার করবেন না, আপনারা সংলাপে বসে সমাধান করুন। সমঝোতা একটাই সবাই জানে প্রকৃত গণতন্ত্র সংবিধান মতোই হোক যেখানে আর্মি, পুলিশ নিরপেক্ষভাবে সব কেন্দ্র পাহারা দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেন, যে সরকার আসবে সেই ক্ষমতা নেবে দেশ চালাবে।
বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যিনি দেশের অভিভাবক তার কথার মধ্যে পরিমিতি নেই। ভাবেন না যে, আমি প্রধানমন্ত্রী আমাকে খুব সংযমী হয়ে কথা বলতে হবে। তা না হলে আমার দেখাদেখি মন্ত্রিপরিষদের অন্যরা আবোল-তাবোল বলবে। সর্বশেষ যে বক্তব্য রেখেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী একজন প্রতিষ্ঠিত নেত্রীকে নিয়ে তা বলা যায় নাÑ ন্যূনতম শিষ্টাচার থাকার প্রয়োজন ছিল। একজন সর্ববৃহৎ দলের নেত্রীর ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য কতটা মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে, তা ভাবে না কেউ। বেগম জিয়ার সন্তান জীবিত আছেÑ একটি দলের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু তার মাকে নিয়ে বলছেন, তার মনের অবস্থা কি হতে পারে একটুও ভেবে দেখবেন না। সবাই তো রক্তমাংসে গড়া, আবেগ অনুভূতির দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যা, রাস্তার ভিখারিরও অনেকটাই তাই। ভিখারি যা ইচ্ছা বলতে পারে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাইলেও অনেক কথা বলতে পারেন না। মন্ত্রী এমপিরা যা বলে দ্বন্দ্ব বাড়ার জন্যই যথেষ্ট। এ ধরনের উসকানি ফৌজদারি অপরাধের শামিল। সারা বিশ্ব যেখানে উদ্বিগ্ন, আমরা কেন এখনো সংলাপে বসছি না। ৯ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডমস বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারের শক্তির অপপ্রয়োগ, বিরোধী দল দমনে গ্রেফতার, গণমাধ্যমের ওপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও সেন্সরশিপ, জনগণের মত দমনের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। অনাকাক্সিত এসব ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অপর দিকে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না’ সরকার অবশ্যই বিষয়টি আমলে নিয়ে সমঝোতার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিরোধী দলের জন্যও বার্তা রয়েছে বিদেশীদের। সেই নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘হার্টস করপোরেশন’র মালিকানা আন্তর্জাতিক পুরনো সংস্থা ‘ফিচরেটিং’ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সংঘটিত কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হবে। বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত তৈরী পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ অবরোধ, সঙ্ঘাত একজন মন্ত্রীরও বেতন কমবে না। কিন্তু শ্রমিকেরা, প্রান্তিক মানুষ না খেয়ে থাকবে। সুযোগসন্ধানী কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ তাণ্ডবের খেলা খেলে বদনাম করবে। তাই সাধারণ মানুষকে টার্গেট করবেন না। যেকোনো একটা ফ্রি নির্বাচন দিয়ে যাচাই করেন, কোন মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে জনপ্রিয়তা। মানুষ ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এই দল বলে ওই দলের দোষÑ পাটাপুতা ঘষাঘষি মরিচের দফা সার। সরকারও এমন ধরনের যে, সারা দিন ‘ডিজিটাল ডিজিটাল’ বলে আর একটু বেকায়দা দেখলে ডিজিটাল কানেকশন সব বন্ধ করে প্রযুক্তির পথ রোধ করে। ১৬ জানুয়ারি জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারের হাইকমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বাংলাদেশের অব্যাহত রাজনৈতিক সঙ্ঘাত বিষয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে সঙ্ঘাত বন্ধের আহ্বান জানান। কমিশনের বিবৃতিতে, বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার এবং আটকের ক্ষেত্রে সরকার যেন স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় না নেয়, পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সে ক্ষেত্রে যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন না ঘটে সে বিষয়েও সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.