মত প্রকাশে বাধা ও বিপন্ন গণতন্ত্র by হারুন-আর-রশিদ

ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গণগ্রেফতার শুরু হয় দেশব্যাপী। বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গণতন্ত্র নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চিন্তিত। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, অতি সত্বর দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রয়োজন। না হলে সঙ্কটের সুরাহা ঘটবে না। সেনাশাসক আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও এরশাদের শাসনামলÑ কোনোটিই জনগণের দুর্বার গণ-আন্দোলনে টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত সরকার ৪২ দিনের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ওই নির্বাচনে মাত্র ৪৯ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। প্রার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৫০ জন।এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও  বৈধতা পায়নি। ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর দুর্বার গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন ঘটে। বাংলার মানুষ যথার্থ সময়ই সমুচিত জবাব দেয় স্বৈরাচারী ও একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকারের বিরুদ্ধে। ভয় দেখিয়ে দেশ শাসন করার দিন ফুরিয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মানুষের মনের কথা শুনুন, এখনো সময় আছে সংলাপে বসে গরমিল শোধরানোর। জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন উপলব্ধি করুন এবং  বিবেক দ্বারা পরিচালিত হোন- চাটুকারেরা অসময়ের বন্ধু নয়, সময়ের বন্ধু। দুর্দিনে ওরা কাছে থাকবে না। মুখে তালা ঝুলিয়ে দেশ শাসন করা যায় না। ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০-এর দিকে তাকানÑ। ৬৫ বছরের একটি ঐতিহ্যবাহী দল, যার কাণ্ডারি আপনি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে ভূমিকা নিতে হবে আপনাকেই।  বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শিগগির একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য সংলাপ শুরু হবে।’ এক বছর পেরিয়ে গেছে অথচ নতুন নির্বাচনের জন্য সংলাপ  শুরুই হয়নি। উল্টো দলের পক্ষ থেকে ‘শব্দবোমা’ ফাটানো হচ্ছে। বিগত ১০টি নির্বাচনের নিরিখে দেখা গেছেÑ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিই সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। কোনো মানদণ্ডেই টেকে না।  বিরোধী দলও যে মন্ত্রিত্ব পায়Ñ সেটা প্রথম দেখা গেল এ দেশে। ১৫৪ জনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। পার্লামেন্টে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাভোটে ‘জয়যুক্ত’Ñ এটাও নজিরবিহীন। অতীতের রেকর্ড (১৯৯৬) ছিল ৪৯ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার। ওই নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যাও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৪৫০, অন্য দিকে ২০১৪ সালে প্রার্থী মাত্র ৫৪৩ জন এবং ১২টি দল অংশ নিয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে দলের সংখ্যা ছিল ৪১। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের সংখ্যা ছিল ৩৮। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের সংখ্যা কম ছিল। এ দুই সময়েই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর দেশ শাসন করে, যা সংবিধানবহির্ভূত। ওই সরকারকে আওয়ামী লীগ বৈধতা দিয়ে বলে, আপনারা আমাদের আন্দোলনের ফসল। আমরা ক্ষমতায় এলে আপনাদের বৈধতা প্রদান করা হবে।’ সেটা হয়েছেও। সেহেতু ২০০৮ সালের নির্বাচনও কলঙ্কমুক্ত নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেক দল অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ থেকেই কথিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেন এবং হারজিতকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে। এক পরিবারেই কয়েকজন নৃশংসতায় প্রাণ হারান।
গত ২ জানুয়ারির জাতীয় দৈনিকে শিরোনাম ছিলÑ সামনে রক্ত ও বারুদের গন্ধ দেখছি, স্বস্তিতে সরকারের বছর পার, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কূটকৌশলে ঘায়েল প্রতিপক্ষ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি কিছুটা মিলেছে, নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও অপকর্মে মলিন সরকারের অর্জন, খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে মাইনাস হতে পারেন (সরকারি দলের নেতার ভাষ্য)। দুই ডিসিসির ভাগফল শূন্য। সাত দফা কেন, ৭০০ দফা দিয়েও কাজ হবে নাÑ বলেছে সরকারি দল। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনায় অন্তত ২০১৯ পর্যন্ত কার্যকর বিরোধী দলের স্থান নেই। ৪ জানুয়ারি আরেকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিলÑ খালেদা জিয়া কার্যত অবরুদ্ধ।  পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের তালা। বিএনপির মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা, বিপন্ন গণতন্ত্র। ৫ জেলায় বিএনপি-জামায়াতের ১৩৯ নেতাকর্মী আটক। ওই দিনের আরেকটি জাতীয় দৈনিকের হেডলাইন ছিলÑ ৫ জানুয়ারি শুধু আমাদের, অন্য কাউকে মাঠে নামতে দেবো নাÑ খাদ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশে একদলীয় শাসন চলছেÑ বিবিসি সংলাপে আইরিন খান। সংলাপ ও নির্বাচনের সম্ভাবনা নেইÑ বাণিজ্যমন্ত্রী। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সরকার পাগলের স্বর্গে বসবাস করছে। বিএনপিকে কোথাও সমাবেশ করতে দেয়া হবে নাÑ ছাত্রলীগের ঘোষণা। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনকÑ ইনু। জনমনে প্রশ্নÑ  এসব খবর মোতাবেক ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ভূমিকা কি গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত করবে? প্রধানমন্ত্রী  ছাত্রলীগ নেতাদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়নি, উনি ইচ্ছা করলে বাসায় চলে যেতে পারেন। উনি অফিসে বসে নাটক করছেন।’ যদি তা-ই হয়, তাহলে সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী  কেন বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে এসে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হলেন? পানিকামান, রায়টকার ও শত শত পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব তার গুলশান কার্যালয়ে কেন মোতায়েন করা হলো! ভিন্ন মতের দলের অফিস বন্ধ এবং দলের চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ করে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় না, এটা সচেতন মানুষমাত্রই বোঝে। ক্ষমতাসীন দলই গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণেÑ  সহিংসতার ব্যাপকতার জন্য তাই তারাই দায়ী। ৪ জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে  বেগম জিয়া বলেছেন, আমাকে বন্দী করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। গণতন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে শাসক দল। তারা স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনা করতে চায়। জনগণের স্বার্থে কথা বলার জন্য  পার্টি অফিসেও বক্তব্য দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের সেবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নিজের দলের লোক বানিয়ে জনগণের কথা বলার অধিকার হরণ করছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে বিএনপির সাতটি সভায় কোথাও সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি। তাহলে ৫ জানুয়ারিতে কেন ঘটবে? আসলে সরকার নিজেই গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়েছে।
গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ বন্ধ করে দিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কালচার প্রসারিত করা হচ্ছে। গণতন্ত্র চর্চার পথে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হলে সহিংসতা ঘটবে। উন্মুক্ত গণতন্ত্রে উন্নয়ন এগিয়ে যায়। তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা এমন দেখা যায়নি। গণতন্ত্রের পথ অবরুদ্ধ করলে গণতন্ত্র তখন আর গণতন্ত্র থাকে না, ভাঙচুর থেকে শুরু করে সব ধরনের বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত ঘটে এবং সে জন্য দায়ী মূলত ক্ষমতাসীন মহল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাশা ছিল শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন হবেÑ সরকার সে কথা বলেছিলও। এর প্রত্যাশার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি ও দৃষ্টান্ত ছিল, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। ওই সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে ছাড়াই একতরফা নির্বাচন করে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় এবং বিজয়ী হয়ে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকত, তাহলে কি আওয়ামী লীগ বেগম জিয়ার অধীনে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিত? বিবেকের কাছে এই প্রশ্নটি রাখার জন্য বিনয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব। খালেদা জিয়ার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার জন্যই কিন্তু জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ দুই বছর আন্দোলনে ছিল। জ্বালাও-পোড়াও এবং  সচিবকে দিগম্বর করা, রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে বিআরটিসি বাসে অগ্নিসংযোগ করে ১২ জন জীবন্ত দগ্ধ  করাসহ চট্টগ্রাম বন্দরকে মাসের পর মাস অচল করে রাখা হয়েছিল তখন। ১৭৩টি হরতাল-অবরোধ পালন করা হয়েছিল।  ‘জনতার মঞ্চ’ বানিয়ে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে মহীউদ্দীন খান আলমগীর সচিবালয়ে চাকরিরত অবস্থায়ই ‘আমলা বিদ্রোহ’ ঘটিয়েছিলেন। সরকারি বিধিমালায়। কাজটি সম্পূর্ণ বেআইনি। মাসাধিককাল ধরে রাস্তাঘাট অবরোধ করে জনগণকে কষ্টে ফেলা হয়েছিল। সেটা যদি অন্যায় না হয়, তাহলে ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রতিবাদে বিএনপি যেটা করছে, সেটা কেন অন্যায় হবে? ক্ষমতায় থাকলে তত্ত্বাবধায়ক ভালো লাগে না; আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক জরুরিÑ এটা আওয়ামী লীগ শিখিয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের চেয়ে নিন্মমানের। তা কিভাবে জাতি মেনে নেবে? স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে  নির্বাচনই পারে বর্তমান পরিস্থিতিকে শান্ত করতে। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো। গত এক বছরে নির্বাচনের এই আনন্দময় সংস্কৃতি বিদায় নিয়ে গেছে। ফিরে এসেছে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার তাণ্ডব। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের মোটেও আস্থা নেই। ১৯৯১ থেকে ধীরে ধীরে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, তা ফিরে পেতে হবে। ৩, ৪, ৫ জানুয়ারি বেগম জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশি কর্মকাণ্ডে প্রমাণ হয়Ñ উন্মুক্ত গণতন্ত্র নয়, অবরুদ্ধ গণতন্ত্রই ক্ষমতাসীন দলের পছন্দ।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক
harunrashid1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.