চট্টগ্রামে আহত চবি ছাত্র সাকিবের মৃত্যু- পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ পরিবারের

চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার কদমতলী এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেলে আহত ইসলামী ছাত্রশিবিরকর্মী সাকিবুল ইসলাম সাত দিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে অবশেষে গত সোমবার রাত ৩টায় ঢাকা অ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তবে পরিবারের দাবি দুর্বৃত্তদের ককটেল বিস্ফোরণে আহত সাকিবকে উল্টো ককটেল বহনকারী সাজিয়ে গ্রেফতারের পর নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া তাকে পুলিশ দেরিতে মেডিক্যালে ভর্তি করে এবং দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়। যার কারণে মেধাবী ছাত্র সাকিবের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত সাকিবুল ইসলাম চট্টগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা গ্রামের মৃত ওসমানুল হকের ছোট ছেলে। তিনি সাত বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
গত ২০ জানুয়ারি রাত ৮টায় নগরীর কদমতলী এলাকায় দুর্বৃত্তরা ককটেল ছুড়ে মারলে পথচারী সাকিবুল ইসলামসহ কয়েকজন আহত হন। এরপর পুলিশ আহতাবস্থায় সাকিবুল ইসলামকে আটক করে।
পুলিশের দাবি, তিনি ককটেল বহন করছিলেন এবং নিজের ককটেলে তিনি আহত হয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের দাবি সে টিউশনি থেকে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে সে আহত হয়। আহতাবস্থায় তাকে পুলিশ ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন চালায়। এতে তার প্রচুর রক্তরণ হয়। পরে ২১ জানুয়ারি রাত ৪টায় পুলিশ তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে তার অবস্থার অবনতি হলে গত ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল সেন্টারে তাকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাকে দুই দিন লাইফ সাপোর্টে রাখার পর ২৬ জানুয়ারি রাতে ঢাকা অ্যাপোলো হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।
আহত সাকিবের মামা শাহেদুল ইসলাম জানান, তার মৃত্যুর জন্য পুলিশ দায়ী। কারণ পুলিশি বাধার কারণে আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে পারিনি। সর্বশেষ তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেয়ার অনুমতি দিলেও, তা নিয়ে অনেক টালবাহানা ও দেরি করেছে পুলিশ। উন্নত চিকিৎসার জন্য বারবার প্রশাসনের কাছে আমরা গিয়েছি; কিন্তু তাদের অবহেলায় আজ আমার ভাগিনা মারা গেছে।
কর্মী নিহতের প্রতিবাদে ছাত্রশিবিরের নিন্দা ও ক্ষোভ
দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেলে আহত ছাত্রশিবিরকর্মী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাকিবুল ইসলামকে আহতাবস্থায় আটকের পর পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরী দেিণর সভাপতি এম এইচ সোহেল ও মহানগরী উত্তরের সভাপতি নুরুল আমিন।
প্রতিবাদ বার্তায় নেতৃদ্বয় বলেন, ২০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় রিকশায় টিউশনি থেকে ফেরার পথে কদমতলীর একটু আগে সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে এলে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেলের আঘাতে সে ও রিকশা চালক মারাত্মক আহত হন। আহত হওয়ার পর প্রায় সাত ঘণ্টা সে নিখোঁজ থাকে। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিভিন্ন থানায় যোগাযোগ করা হয়েছিল; কিন্তু পুলিশ তাকে আটকের কথা স্বীকার করেনি। অবশেষে রাত ৪টায় তার বড় বোনের ফোনে একজন ব্যক্তি ফোন করে জানান সে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের পঞ্চম তলার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন।
হাসপাতালে এসে দেখা যায় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন বিশেষ করে তার মাথা, হাত ও মুখে প্রচণ্ড আঘাত। পরে খবর নিয়ে জানা যায় আহতাবস্থায় পুলিশ তাকে আটক করে থানায় রেখে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের একপর্যায়ে সে রক্তবমি করলে পুলিশ তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নিয়ে যায়।
নির্যাতনের শিকার সাকিব
লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, এ দিকে নিহত সাকিবের ফুফাতো ভাই শাহেদুল হক কাতেবী অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই যথাযথ চিকিৎসা দেয়া গেলে হয়তো সাকিবকে বাঁচানো সম্ভব হতো। বুধবার সন্ধ্যায় সাকিবের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার মা সালেহা বেগম। পুটিবিলা ইউনিয়নের তাঁতিপাড়া গ্রামের মরহুম মাওলানা ওসমানের সাত মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সাকিব সর্বকনিষ্ঠ। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তার সাত বোন।
সাকিবুলের মায়ের বিবৃতি : গত ২০ জানুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার কদমতলীতে দুর্বৃত্তদের আঘাতে মারাত্মক আহত সাকিবুল ইসলামকে নির্মম নির্যাতন ও চিকিৎসা করতে না দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন নিহতের মা সালেহা বেগম।
গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমার সন্তান সাকিবুল ইসলাম প্রতিদিনে মতো টিউশনি করে বাড়ি ফেরার সময় দুর্বৃত্তদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়। এ সময় পুলিশ তাকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে। কিন্তু গ্রেফতারের পর চিকিৎসা না করে উল্টো ৬ ঘণ্টা তাকে নির্যাতন করে। এই বর্বর নির্যাতনে আমার ছেলের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু তারা উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। আমরা বারবার তার জীবন বাঁচাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য আবেদন জানালেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। পুলিশের ভয়াবহ নির্যাতন ও চিকিৎসা করতে না দেয়ায় আমার ছেলে মারা যায়।
তিনি বলেন, যদিও আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি তবুও পুলিশের হেফাজতে থাকায় সে মানবিক সাহায্যটুকু পাবে এমনটি আমরা আশা করে ছিলাম। কিন্তু পুলিশের এই অমানবিক নির্মম হত্যাযজ্ঞ আমাদের বাকহীন করে দিয়েছে। আমার জানা মতে, সে কোনো অন্যায় করেনি। আর যদি আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেই থাকে তাহলে আইনের মাধ্যমে তার বিহিত করার কথা ছিল। কিন্তু আইনের রক্ষক হয়ে পুলিশ যেভাবে আমার ছেলেকে নির্যাতন ও অমানবিক অবহেলা করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তাতে পুলিশের প্রতি আমাদের আস্থা হারিয়ে গেছে। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয় তার জন্য আমি অবিলম্বে নির্যাতন ও অবহেলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করছি। একইভাবে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিজ্ঞপ্তি।

No comments

Powered by Blogger.