ভিন্ন কৌশলে ক্রসফায়ার

পাল্টাচ্ছে নাম আর ধরন। তবে থেমে নেই ক্রসফায়ার। বিরোধী জোটের টানা অবরোধের মধ্যে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে তা। নানা নামের ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছেন বিরোধী কর্মীরা। গত ১২ দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি অনুযায়ী সারা দেশে কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছেন ৮ জন। এর বাইরে গত মঙ্গলবার র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর এক শিবির নেতা মারা গেছেন। র‌্যাবের দাবি, পালাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছেন তিনি। যদিও নিহতের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, তাকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগে ঘটনাস্থলেই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এখন আটকের পর ‘পালাতে’ গিয়ে বা ‘সহযোগীদের’ গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোন কোন ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে আটকের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে হাসপাতালে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে আটকের পর ট্রেন লাইনে ফেলে রাখা বা সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা সাজানোর অভিযোগও রয়েছে। মানবধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ক্রসফায়ারের ধরণ পাল্টে গেছে। গত কয়েক দিনে অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকজন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। এখনকার ক্রসফায়ারে দেখা যাচ্ছে ১৫-২০ রাউন্ড গুলি পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই বিরোধী জোটের নেতাকর্মী। এভাবে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্রসফায়ার চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নিহত বিরোধী নেতাকর্মীরা সবাই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আন্দোলন দমানোর জন্য ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি চালু করা সমীচীন নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের ১০ দিন পর থেকে আশঙ্কাজনকভাবে ঘটতে থাকে একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা। গত ১২ দিনে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ৮ জন। এদের মধ্যে পাঁচ জন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী। বাকি তিন জন দুষ্কৃতকারী বলে দাবি করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর বাইরে চাঁপাই নবাবগঞ্জে যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ট্রাক চাপায় আসাদুজ্জামান তুহিন নামে এক শিবির নেতা নিহত হয়েছেন। নিহতদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, গ্রেপ্তার করার পর পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি করে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। নিহত তুহিনের পরিবার দাবি করেছে, র‌্যাব তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
সূত্র জানায়, গতকাল ভোরে রাজশাহীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন স্থানীয় জামায়াত নেতা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম শাহীন। তবে পরিবারের অভিযোগ, তাকে আটক করার পর ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ করেছে ডিবি পুলিশ। গত মঙ্গলবার বিকালে পদ্মা অফসেট থেকে জামায়াত নেতা নূরুল ইসলাম শাহীনকে ধরে নিয়ে যায় ডিবি। পরে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়। রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম শাহীনকে নিয়ে নগরীর নলখোলা আশরাফের মোড় এলাকায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। এ সময় জামায়াত-শিবিরকর্মীদের সঙ্গে ডিবি পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। তখন পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন নূরুল ইসলাম। নিহত নূরুল ইসলাম শাহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার ইসলামীয়া কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। গতকাল ভোরে সাতক্ষীরার পাটকেল ঘাটায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রফিকুল ইসলাম নামে অপর এক ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশের দাবি, পাটকেলঘাটা থানার কুমিরা ইউনিয়নের অভয়তলায় একদল ডাকাত ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে ভোরে পুলিশ সেখানে যায়। এ সময় ডাকাতরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন রফিকুল। তবে নিহত রফিকুলের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক সাজিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিহত রফিকুল ইসলাম পাটকেলঘাটা থানার নোয়াকাটি গ্রামের বাবর আলীর পুত্র। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ২৬শে জানুয়ারি রাজধানীর রামপুরায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবুল কালাম ও সুলতান নামে দুই যুবক নিহত হন। র‌্যাবের দাবি, ওই দুই যুবক দুষ্কৃতকারী। তবে নিহতের স্বজনদের দাবি, তারা দুষ্কৃতকারী না। নিহত আজাদের স্ত্রী শাহিনূর জানান, তার স্বামী কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি পেশায় একজন প্রাইভেটকার চালক। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। একইভাবে নিহত সুলতানের স্ত্রী সাবিনা জানান, গত বছরের ২১শে ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সুলতান। এর আগে গত ২৩শে জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন লক্ষ্মীপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা সোলাইমান উদ্দিন জিসান (২৮)। র‌্যাব জানায়, ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে লক্ষ্মীপুর আসার পথে কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় র‌্যাব তার মোটরসাইকেলটি থামানোর জন্য চেষ্টা করে। এ সময় জিসান মোটরসাইকেল না থামিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে র‌্যাব সদস্যরা তাকে ধাওয়া করে। এতে জিসান র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে জিসান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান ওরফে জনি। কারাগারে আটক ছোট ভাইকে দেখা করতে গেলে সেখান থেকে সোমবার ডিবি তাকে আটক করে। পরদিন জোড়াপুকুরপার এলাকায় তাকে নিয়ে অভিযান চালানোর সময় সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে দাবি করা হয়। এ সময় সহযোগীদের গুলিতেই জনি নিহত হন বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নূরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভীন মনীষা অভিযোগ করেন, ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার কারণেই তাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে।
জনি নিহত হওয়ার একদিন আগে মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস। তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আসেন। নিহত হওয়ার চার দিন আগে তিনি নিখোঁজ হন। তাদের অভিযোগ, ডিবি থেকে তাকে আটক করে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে। গত ১৬ই জানুয়ারি যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে র‌্যাবের হাতে আটকের পর চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান নিহত হন। নিহত মতিউর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। মতিউরকে নিয়েও মধ্যরাতে অভিযানে গিয়েছিল র‌্যাব। এসময় মতিউরের সহযোগীরা র‌্যাবের ওপর গুলি ছুড়লে র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতেই মতিউর গুলিবিদ্ধ হয় বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.