চট্টগ্রামে মধ্যযুগীয় কায়দায় চোখ তুলে সন্ত্রাসীদের উল্লাস by মহিউদ্দীন জুয়েল

ওরা প্রথমে আমার স্বামীর শরীরের সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলে। এরপর হাসতে হাসতে ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তার দুই চোখের কঠোরে। মুহূর্তেই রক্তমাখা চোখের মণি বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। এরপর উৎসুক জনতার উদ্দেশে বলে, কেউ সামনে এগুবি না। আসলে তোদের পরিণামও এমন হবে। একথা বলে বড়সড় একটি রামদা দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। একপর্যায়ে আমার স্বামী জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তারা মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে চলে যায়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৬নং ওয়ার্ডের বারান্দায় বসে এভাবেই মধ্যযুগীয় কায়দায় স্বামীর চোখ উৎপাটনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন স্ত্রী খালেদা আকতার। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। ভয়। অজানা আশঙ্কা তখনও তাড়া করে ফিরছিল তাকে। জানালেন, আধিপত্য বিস্তার আর সম্পত্তির লোভের জের ধরে কিভাবে তার স্বামী নুরুল আবছার (৩২)-কে নির্যাতন করেছে আপনা চাচা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। চোখ তুলে ফেলার পর করেছে উল্লাস। সন্ত্রাসীদের ভয়ে সবাই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম। মুমূর্ষু অবস্থায় আহত নুরুল আবছার এখন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার পুরো মুখ ব্যান্ডেজে মোড়া। পুরো শরীর অবশ। কারণ দুই পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে। জিহ্বা কর্তন করায় কথাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন বেঁচে থাকলেও সারা জীবন তাকে পঙ্গু হয়েই বাঁচতে হবে। গতকাল দুপুরে ঘটনার বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন শত শত মানুষ ভিড় করছিলেন এ ব্যক্তির পাশে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিসৎক ডা. রাজীব বড়ুয়া জানান, আহত নুরুল আবছারের জখম ভয়াবহ। সে আর দেখতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তার বেশ কয়েকটি অপারেশন করতে হবে।  ঘটনার বিবরণ দিয়ে নুরুল আবছারের ভাই ও স্ত্রী জানান, দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় তার চাচা শরীফ বাদশার সঙ্গে বিরোধ চলে আসছিল। শরীফ বাদশা খুবই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মহেশখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়ে কাজ করছেন। তার ভাতিজা নুরুল আবছারও যুবলীগের একজন নেতা বলে জানায় তারা। বেশ কিছুদিন আগে আবছারকে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র গ্রেপ্তার করে। এরপর সে ছাড়া পেলে দু’জনের মধ্যে বিরোধ পুনরায় দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে আবছারের পারিবারিক সূত্রের দাবি, বাড়িতে অস্ত্র রেখে সিনেমা স্টাইলে তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছে সেই চাচা। গত বুধবার বিকাল ২টা। বাড়ি থেকে বের হয়ে তাবলীগে যাওয়ার জন্য একজনের কাছ থেকে টাকা আনতে বের হয় আবছার। এরপর পথে বড় মহেশখালীর মগরিয়া হাট এলাকায় তার রিকশা পৌঁছলে গতিরোধ করে সন্ত্রাসীরা। তারা প্রথমে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামায়। এরপর পরনের জামা-কাপড় খুলে ফেলে। উলঙ্গ অবস্থায় তাকে দেখে লোকজন এগিয়ে আসলে তারা গুলি ফোটাতে শুরু করে। পরে একজন সন্ত্রাসী কোমরের পেছনে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে তার দুই চোখের মনি টেনে বের করে ফেলে। মুহূর্তেই সেখানে চিৎকারের রোল উঠে। এরপর সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে চলে যায়।  নুরুল আবছারের স্ত্রী খালেদা আকতার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, এ ঘটনায় আমরা চেয়ারম্যান পুত্র নিশান, আবু তাহের, জয়নাল, নুরুল আমিন, কামাল পাশা, সালমান, রোকন, গফুর, ইসহাক, এনাম, মকছুদ মিয়াসহ ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে পুলিশকে বলেছি। তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সবাই দেখেছে। ওরা আমার স্বামীর চোখ তুলে নিয়েছে। কেবল তাই নয়, মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার দুই পায়ের রগ ও জিহ্বা কেটে দিয়েছে। নুরুল আবছারের বোন রুবি আকতার বলেন, এমন নৃশংস ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি। আমরা কিভাবে সামনের দিনগুলোতে বাঁচবো তা জানিনা। কারণ সন্ত্রাসীরা এখনও আমাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তারা এতটাই শক্তিশালী যে থানা পুলিশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রাখে। নুরুল আবছারের ভাই হাসান শাহরিয়ার বলেন, আমার চাচা আওয়ামী লীগের লোক। আমার ভাইও যুবলীগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারপরও আমার সন্ত্রাসী চাচার হাত থেকে রেহাই পায়নি কেউ। স্থানীয় লোকজন, এমপি, পুলিশ সব তার কথায় চলে। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পরপরই তাকে মহেশখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কক্সবাজার হাসপাতালে। এরপর গত বুধবার রাতে চট্টগ্রামে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। সেখানকার ডাক্তাররা জানিয়েছেন তিনি আর কখনোই চোখে দেখতে পারবেন না। হাঁটাচলাতেও শক্তি পাবেন না বলে সেখানকার চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদ জানিয়েছেন। নুরুল আবছারের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। ঘটনার বিষয়ে ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে তানজিন আছসার সাথী বলেন, আমার বাবাকে ওরা এলোপাতাড়ি মেরেছে। চোখ তুলে উল্লাস করেছি। চোখ বন্ধ করলেই মুহূর্তে এই দৃশ্য ভেসে আসে। আমরা কি বেঁচে থাকতো পারবো। এ বিষয়ে মহেশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, অভিযুক্তদের নাম পেয়েছি। তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঘটনাটি লোমহর্ষক। এভাবে কোন ঘটনা এর আগে ঘটতে শুনিনি। চোখ তুলে নেয়ার ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.