নার্ভাস সরকারে নানা উপসর্গ by আলফাজ আনাম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান বা নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঘটনাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধানকে বাসা বা অফিসের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখা বা তিনি যাতে বের হতে না পারেন সে জন্য বালু ও ইটের ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনার কোনো নজির নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের উদ্ভাবনী শক্তি বিরল। আওয়ামী লীগ প্রথম বাংলাদেশে টানা এক সপ্তাহ থেকে টানা ১৭ দিনের হরতাল পালন করেছে। ঈদের আগের দিন ও পরের দিনও হরতাল ডেকেছে। হরতালের মধ্যে হেঁটে চলা অফিসগামী সরকারি কর্মচারীকে দিগম্বর করেছে। এগুলো এরা করেছে যখন বিরোধী দলে ছিল। এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ঠেকানোর জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে, আন্তর্জাতিক মহলে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে কিংবা গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে দাবি করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে আচরণের মাত্রা কোন পর্যায়ে রাখা উচিত সে সম্পর্কে তাদের কোনো বিবেচনাবোধ থাকছে না। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী সরকার স্বাভাবিকভাবে জনসমর্থনহীন হয়ে পড়ে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে অস্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের প্রতিটি দিন পার করতে হচ্ছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তাতে সরকারের পুরো আচরণ ছিল অস্বাভাবিক। বেগম খালেদা জিয়াকে ৩ জানুয়ারি শুধু অফিসে আটকে রাখা হলো না। এরপর সারা দেশে সরকারিভাবে অবরোধ আরোপ করা হলো। ঢাকার সাথে বাস, লঞ্চ এমনকি ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলো। অথচ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের এই কর্মসূচি ছিল একান্তই ঢাকাকেন্দ্রিক। বিএনপির একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে থেকে লোকসমাগম করার কোনো পরিকল্পনা বা নির্দেশনা দেয়া হয়নি। কিন্তু সরকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল শুধুই আতঙ্ক থেকে। এরপর বেগম খালেদা জিয়াকে কেন তার অফিসে আটকে রাখা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে অসত্য ও পরস্পরবিরোধী তথ্য উপস্থাপন করেছেন তাতে বাংলাদেশের প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটির দেউলিয়াত্বই শুধু প্রকাশ পায়নি; মনে হচ্ছে নার্ভাস এই সরকার যেন জনগণকে বোকা ভাবছে। ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে মতবিনিময়ের সময় বলেন, ‘কয়েক দিন আগে উনি (খালেদা জিয়া) চিঠি দিয়েছেন উনার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। যেই নিরাপত্তা জোরদার করতে গেলাম, এখন বলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। মানুষ যাবে কোথায়? উনি চিঠি দিলেন উনার নিরাপত্তা দিতে হবে যে, ওনার নিরাপত্তা প্রয়োজন। পুলিশ যখন নিরাপত্তা দিলো তখন বলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। উনি তো বন্দী নন। ইচ্ছে করলে উনি উনার বাসায় এখনই যেতে পারেন।’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৫ জানুয়ারি বলেন, নিরাপত্তা চেয়ে এর আগে খালেদা জিয়া সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন বলেই সরকারের তরফ থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে। খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ নন। তাকে আটকও করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তিনি নিরাপদ, তাহলে তিনি বাসায় কিংবা নয়া পল্টনের কার্যালয়ে যেতে পারেন। একই দিন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ইট ও বালুর ট্রাক খালেদা জিয়া তার বাড়ি সংস্কারের জন্য এনে রেখেছেন। যখনই এ ধরনের পরিস্থিতি হয় তখনই তিনি এ কাজটি করেন। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রীরা যখন খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রাখার এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তখন টেলিভিশনগুলোতে বিএনপির গুলশান অফিস থেকে সরাসরি সম্প্রচারে দেখানো হয়, কিভাবে বালু ও ইটের ট্রাক আর পুলিশের গাড়ি দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়েছে। ধরে আনা ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপাররা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কী বলেছে। দেশের মানুষ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে দেখেছে, অফিসের গেটে পুলিশ কিভাবে তালা লাগিয়ে দিয়ে নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের অফিসে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী যখন বাসায় ঢুকতে চেয়েছিলেন তখন বাধার মুখে তিনি কিভাবে ফিরে যান। মানুষ সবই টেলিভিশনে দেখেছে। দেশের মানুষ সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য বিশ্বাস করবে, না টেলিভিশনে নিজ চোখে দেখা দৃশ্য অবিশ্বাস করবে। খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করার আগে সরকারের উচিত ছিল দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া। নিদেনপক্ষে এই নির্দেশনা জারি করা, টেলিভিশনে খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করা যাবে না। তাহলে হয়তো সরকার সমর্থক কিছু মানুষ সরকারের এসব ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারত। ৫ জানুয়ারি যখন খালেদা জিয়া বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখনো পুলিশ বাসার গেটে শুধু তালা দেয়নি সারিবদ্ধভাবে তারা গেটে দাঁড়িয়েছিল। ভেতরে আটকে থাকা মহিলা দলের কিছু নেতাকর্মী যখন গেট খুলে দেয়ার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন পুলিশ পিপার স্প্রে করে অর্থাৎ তরল মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়া হয়। এরপর খালেদা জিয়া যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখনো পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। একজন রাজনৈতিক নেতাকে বাসায় তালাবদ্ধ রেখে পিপার স্প্রে করা শুধু অমানবিক নয়, নৈতিক দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ। আজকে সরকারের মন্ত্রীরা খালেদা জিয়াকে উসকানিদাতা হিসেবে হত্যা মামলার আসামি করা হবে বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। অথচ খালেদা জিয়া তাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনতে পারেন। তার অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণও হাজির করতে পারেন। ভবিষ্যতে এরা এই অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিরাপত্তা চেয়ে খালেদা জিয়ার চিঠির প্রসঙ্গ তুলেছেন। নিরাপত্তা মানে কি মানুষকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রাখা? পিপার স্প্রে করা। লোকজনের সাথে দেখা করতে বাধা দেয়া? আমরা আগেই বলেছি রাজনৈতিক কূটকৌশলে আওয়ামী লীগের উদ্ভাবনী শক্তি বিরল। বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় এখন যে কৌশল প্রয়োগ করছে তাকে আমরা রাজনৈতিক ডাকাতির কৌশল বলতে পারি। ডাকাতেরা যেমন বাড়ির মালামাল লুট করার জন্য গৃহকর্তাকে আটকে রেখে ডাকাতির কাজ সম্পন্ন করে তেমনিভাবে বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রী যাতে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না পারেন সে জন্য আটকে রাখা হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়াকে একইভাবে বালুর ট্রাক দিয়ে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি যখন মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসির নামে সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন, তখনো তাকে এভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। তাকে অবরুদ্ধ রেখেই  ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছে। ১৫৪ জন এমপি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি আসনগুলোতে ভোট হলেও কোনোভাবেই ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না। বর্তমান সরকারেরও সে নৈতিক ভিত্তি নেই। এ নির্বাচনের আগেই সরকার গঠনের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। দ্বিতীয়বার এই নৈতিক পরাজয় হলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে গণতন্ত্রের বিজয় উৎসব পালন করার মাধ্যমে। বেগম খালেদা জিয়াকে আটকে রেখে প্রমাণ করা হয়েছে তার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি। জনগণ তার সাথে আছে এবং এটাই সরকারের জন্য ভয়ের কারণ। সরকার এতটাই বিপন্ন বোধ করছে যে একটি সমাবেশের ডাকেই নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এ কারণেই ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এরা নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। যেহেতু এ ধরনের সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের জনসমর্থন থাকে না। সে কারণে দলীয় কিংবা জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ সৃষ্টি করে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাকে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের রূপ হিসেবে দেখতে পারি। আমরা দেখছি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতাসীনদের যে সুবিধাভোগী সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়েছে তাদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। পুলিশের সাথে আমরা সশস্ত্রভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের দেখছি। এমনকি সাংবাদিকদের মাঝেও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের উগ্র আচরণও লক্ষ করছি। প্রেস কাব থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গ্রেফতারের ঘটনায় এই সাংবাদিকেরা ন্যূনতম পেশাগত সৌজন্যতাও দেখাতে পারেননি। আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকেরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে সজ্জন ও ভদ্র রাজনৈতিক নেতা হিসেবে টেলিভিশনে আমন্ত্রণ জানাতেন। এমনকি প্রকাশ্যে প্রশংসাও করতেন। কিন্তু এরাই আবার মির্জা ফখরুলকে প্রেস কাব থেকে বের করে দেয়ার আলটিমেটাম দিয়েছেন। এমনকি মির্জা ফখরুলের চামড়া তুলে নেবো আমরা বলে স্লোগান দিয়েছেন। মির্জা ফখরুল নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি বেদনাহত হয়েছেন পুলিশ যখন তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাকে রাজাকার ফখরুল বলে স্লোগান দেয়া হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরও তিনি রাজাকার হয়ে গেলেন। সাবেক ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন ফ্যাসিবাদের লকলকে জিহ্বা কিভাবে মানুষকে আঘাত করে। অবশ্য ৫ তারিখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠন কিভাবে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগের সেকুলার রাজনীতি অনুসরণ করলে বিএনপির রাজনৈতিক সাফল্য আসবে বলে যারা মনে করেন, তারা মির্জা ফখরুলের রাজাকার হওয়ার পরিণতি থেকে শিক্ষা নেবেন। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সশস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর দলীয় পেশিশক্তি দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে কত দিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে তা সরকার নিজেও জানে না। এ কারণে আমরা দেখছি যেকোনো ভিন্নমতকে ক্ষমতাসিনরা টিকে থাকার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। শুধু রাজনৈতিক দল নয় সামাজিক সংগঠন কিংবা গণমাধ্যমকেও তারা হুমকি হিসেবে দেখছে। এক দিকে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে গুম, খুন, গণগ্রেফতার আর নিপীড়নের মাধ্যমে দেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। আর এসবের প্রতিক্রিয়া কোন প্রক্রিয়ায় ঘটবে এই আশঙ্কায় সরকারও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বাভাবিক গতি আর থাকছে না। অতীতে এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসান হয়েছে। আলফাজ আনাম: সাংবাদিক alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.