ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু আজ- পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা by এম এ হায়দার সরকার

বিএনপিসহ ২০ দলের ডাকা অবরোধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব টঙ্গীর তুরাগতীরে শুরু হচ্ছে আজ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস-ট্রাক, ট্রেন ও লঞ্চযোগে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লি  ইজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। পুরো মাঠের ৪০ খিত্তায় জেলাওয়ারি তাবলীগ জামাতের মুসল্লিরা নির্দিষ্ট খিত্তায় বুধবার থেকে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। গতকাল সারা দিনই দলে দলে মুসল্লিদের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। আগামী ১১ই জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের এ সমাবেশ। ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১৬ই জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৮ই জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। আগত মুসল্লিদের জন্য টঙ্গীর তুরাগ তীরে ১৬০ একর খোলা জমিনের ওপর পাটের চট দিয়ে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। তাবলীগ জামাতের এ মিলনমেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশ থেকে ৩০-৪০ হাজার বিদেশী মেহমান অংশ নেবেন বলে আয়োজকরা আশা করছেন। গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিশ্বের ৬৪টি দেশের ১০ হাজার তাবলীগ অনুসারী ইজতেমাস্থলে এসে পৌঁছেছেন বলে জানা গেছে। লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে আজ দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে এ ইজতেমা ময়দানে। ইজতেমাকে ঘিরে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা। ইজতেমাস্থলের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্যাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে পুলিশের এক ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এবারের বিশ্ব ইজতেমায় প্রচলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরেও আধুনিক প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যে কোন প্রকার নাশকতা রোধে পুলিশের সব ধরনের প্রন্তুতি রয়েছে। জেলা পুলিশ, আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়ন, শিল্প পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, মেট্রো পুলিশ ও সাদা পোশাকে প্রায় দুই পর্বের ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ১২ হাজারের মতো নিরাপত্তাকর্মী কাজ করবেন। ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা, মন্নুগেট থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত এবং তুরাগ নদীসহ পুরো এলাকাকে ৫টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করবেন। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে থাকবে চেকপোস্ট, ওয়াচ টাওয়ার, ইজতেমার প্রতিটি প্রবেশ পথে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা মনিটরিং করা হবে। এছাড়া বাইনোকুলার, মেটাল ডিটেক্টর, কন্ট্রোল রুমও স্থাপন করা হচ্ছে। এ সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ পুলিশ বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুপুর ১২টায় র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ প্রেস বিফিং এ ইজতেমাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাব বিশ্ব ইজতেমায় আগত সব মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে নিয়োজিত রয়েছেন। যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড যে কোন মূল্যে র‌্যাব প্রতিহত করবে বলে তিনি জানান। এ সময় তিনি র‌্যাবের একটি ফ্রি মেডিকেল সেন্টার ঘুরে দেখেন। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মো. জাহিদ আহসান রাসেল এবং স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক উপস্থিত ছিলেন। এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ইজতেমা মাঠ এলাকায় র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল দিতে দেখা গেছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গতকাল সকালে ইজতেমার মাঠ পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি জানান, ইজতেমা মাঠের বিদ্যুতের ঘাটতি হবে না। বিদ্যুতের জন্য সর্বোচ্চ  ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনটা ফিডার থেকে ইজতেমা মাঠে সংযোগ দেয়া হয়েছে। ইমার্জেন্সি সাপোর্ট হিসেবে সার্বক্ষণিক স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর রাখা হয়েছে। মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইজতেমায় দায়িত্বপালনকারী  সকল চিকিৎসক ও কর্মচারীদের ছুটি ৮ই জানুয়ারি থেকে ১৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে বলে জানান গাজীপুরের সিভিল সার্জন মো. আনিসুর রহমান। তিনি আরও জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিক্যাল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। তিন শিফেট ১৬ জন বিশেষজ্ঞ  চিকিৎসক ছাড়াও ৬৩ জন মেডিক্যাল অফিসার ইজতেমা ময়দানে ডিউটি করবেন। মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারাখানার গেট, বিদেশী মেহমানখানা ও তুরাগের পশ্চিম তীরে আরও ২টি অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। টঙ্গী হাসপাতালে এখানে হৃদরোগ, অ্যাজমা, ট্রমা, বার্ন, চক্ষু এবং ওআরটি কর্নারসহ বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ চিকিৎসা দেবেন। মুসল্লি রোগীদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সার্বক্ষণিক ১২টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে। এছাড়া ইজতেমা মাঠের উত্তরে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অর্ধশত  ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থানের কাজ চলছে।
ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন: বৃহস্পতিবার দুপুরে রেলমন্ত্রী মজিবুল হক ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ মোতয়ালি ড. হাকিম মো. ইউসুফ হারুন ভূঁইয়া।  প্রধান অতিথির বক্তৃতায় রেলমন্ত্রী বলেন, হামদর্দ আর্তপীড়িত ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের জন্য হামদর্দ প্রতিবছর যে উদ্যোগ গ্রহণ করে তা সত্যিই প্রশসংনীয়। দ্বীন ইসলামের খেদমতে যারা জান মাল ও সময় ব্যয় করছেন তাদের খেদমতের মাধ্যমে হামদর্দের সদস্যবৃন্দ অশেষ পূণ্য লাভ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। হামদর্দের মতো মানব সেবায় এগিয়ে আসার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।  এছাড়াও ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প এলাকায় জনকল্যাণ ফার্মা, রেনাটা, বিএমএ, র‌্যাব, টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ফাউন্ডেশন, ইস্পাহানী ইসলামীয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট, যমুনা ব্যাংক, এপেক্স বাংলাদেশ, কিউআইএস মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনসহ প্রায় ৪৪টি সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রি-চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে।
স্বাস্থ্যসেবা: গাজীপুর সিভিল সার্জন আনিসুর ইসলাম বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে সব প্রস্তুতি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। টঙ্গী সরকারি ৫০ শয্যা হাসপাতালে আরও ৫০টি শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হাসপাতালে একটি নিজস্ব কন্ট্রোল রুম ছাড়াও কার্ডিয়াক, বার্ন, অ্যাজমা, ট্রমাসহ বিভিন্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের উদ্যোগে মুন্ন গেট, বাটা গেট হোন্ডা রোডে ও বিদেশী ক্যাম্পসহ মুসল্লিদের তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার জন্য ৫টি মেডিকেল সেন্টার খোলা হয়েছে। মুসল্লিদের সেবা প্রদানের জন্য টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল সেন্টারগুলোয় ১২টি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইজতেমা এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ৪৪টির মতো ফ্রি-মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। হোটেলে খাবারের মান ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটসহ  সেনিটেশন টিম কাজ করছে।

No comments

Powered by Blogger.