আজকের লাইগা বিরোধী দল, এমনিতে সরকার by একরামুল হুদা ও মাহবুবুল হক ভুঁইয়া

(প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সারা দেশ থেকে এই গাড়িতে করেই এসেছেন নেতা-কর্মীরা। ছবি: মনিরুল আলম) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশে এসেছেন শুক্কুর মিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে রাখা একটি বাসে বসে ছিলেন তিনি।
সমাবেশে না গিয়ে বাসে বসে আছেন?
‘আমি তো জাতীয় পার্টি করি না। আওয়ামী লীগ করি। তাই বসে আছি।’
তাহলে এসেছেন কেন?
‘আমরা তো একই, তাই আসছি। বন্ধুবান্ধব অনেকেই আসছে তো, তাদের সঙ্গে আসছি। তবে এখন ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।’
তাঁর মতো আরও কেউ এসেছে কি না, জানতে চাইলে শুক্কুর মিয়া বললেন, ‘আমাদের গাড়িতে আট-দশজন এসেছে। অন্যান্য গাড়িতেও এসেছে।’ এরপর থেমে বললেন, ‘কম না, আওয়ামী লীগের লোক ভালোই আসছে।’
ঢাকার উত্তরা থেকে জাতীয় পার্টির সমাবেশে এসেছেন পেশায় রাজমিস্ত্রি মো. মহসিন। তিনি এসেছেন দলের প্রতি ‘ভালবাসা’ থেকে। জাতীয় পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘এখনো বিরোধী দল হয় নাই, হইব।’
জাতীয় পার্টির ২৯তম জন্মদিন উপলক্ষে আজ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে দলটি। এতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মহসিনের মতো দলের প্রতি ‘ভালোবাসা’ থেকে এসেছেন এমন শতাধিক লোকের সঙ্গে কথা হয়। দলকে ‘ভালোবেসে’ সমাবেশে এলেও তাঁদের অনেকেই জানেন না জাতীয় পার্টি সরকারি দলে, না বিরোধী দলে আছেন।
শ্যামপুরের একটি বেভারেজ কোম্পানিতে কাজ করেন একজন শ্রমিক হেমায়েত মোল্লা। তিনি এসেছেন ঢাকা-৪ আসনের সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার এলাকা থেকে। বলেন, ‘পার্টি সরকারি দলে। রওশন এরশাদ সরকারের সঙ্গে মিশছে। বাবলাও সরকারের সঙ্গে মিশে এমপি হইছে।’
কেরানীগঞ্জ থেকে আসা মো. আমিনও মনে করেন জাতীয় পার্টি সরকারি দলে আছে। বলেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে আছে না!’ নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পরিবহন শ্রমিক মো. শহীদ, সুজন, রাহুল, মোক্তার হোসেন, রিয়াজসহ আরও অনেকেই মনে করেন, জাতীয় পার্টি সরকারেই আছে। সুজন বলেন, ‘আজকের লাইগা বিরোধী দল, এমনিতে সরকার।’
তবে ময়মনসিংহ থেকে আসা মোজাম্মেল হক, হুমায়ুন কবীর, ঢাকার জুরাইন থেকে আসা ফজলে রাব্বী, জিয়াদ হাসান, শরীফ, অভিসহ এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা জানেনই না জাতীয় পার্টি সরকার না বিরোধী দলে। সায়েদাবাদ থেকে আসা লিপি আক্তার যেমন বললেন, ‘রাজনীতির যে মারপ্যাঁচ তা আমার বুঝে আসে না, জাতীয় পার্টি সরকার দলে, না বিরোধী দলে আছে।’
উত্তরার নির্মাণশ্রমিক মো. হিরু সমাবেশে আসেন এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মধ্যে নাই, তাই এমন কিছু বুঝিও না।’ আজকে দলের প্রতি ‘ভালোবাসা’ থেকে এলেও তিনি জানান এর আগে অন্য এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে।
জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে আছে, এমনটা বলেছেন এ রকম মানুষও পাওয়া গেছে। রংপুরের গঙ্গচড়া উপজেলার লক্ষীটারি ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, যুব সংহতির সহসভাপতি জাহিদুর রহমান এবং সাহিত্য-পাঠাগার সম্পাদক কফিল উদ্দিনের মতো যাঁরা দলের কোনো না কোনো পদে আছেন, তাঁদের মতে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলেই আছে।
সোহরাওয়ার্দীর আশেপাশেই ২০০ যানবাহন
এসব সাধারণ লোকজন দলের ভাড়া করা গাড়িতে এসেছেন। কথা হচ্ছিল ঢাকা-গাজীপুর পথের বলাকা বাসের চালক ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘ভাড়া পাব কি না, জানি না। সকালে যাত্রী নিয়ে টঙ্গী যাচ্ছিলাম। পার্টির লোকেরা গাড়ি আটকে নিয়ে এসেছে।’ তিনি জানালেন, এভাবে অনেক বাসই টঙ্গী থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
তবে সবার অবস্থা এমন নয়। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশে আসা প্রায় সব যানবাহনই এসেছিল ভাড়ায়। তবে দূরপাল্লার যানবাহন তুলনামূলক কম ছিল, রাজধানীর আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা যানবাহনের সংখ্যাই ছিল বেশি ।
মৎস্য ভবন থেকে শিল্পকলা একাডেমী পর্যন্ত রাস্তায় ৫০ থেকে ৬০টি, হাইকোর্ট মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত প্রায় দেড় শটি, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় ২০টি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের সামনের রাস্তায় ১৫টির মতো সমাবেশে আসা গাড়ি দেখা গেছে। তবে এসব এলাকা ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখে বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশে আসা গাড়ি রাখা হয়েছে বলে বাসচালকেরা জানিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকেই প্রায় ২০০ বাস নিয়ে আসা হয়েছে বলে একাধিক বাসচালক জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, বাসপ্রতি ভাড়া দেওয়া হয়েছে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
গাজীপুর থেকে আসা একাধিক বাসচালক জানান, ওই জেলা থেকে ৭০-৮০টি বাস এসেছে। গাজীপুর থানা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি বাবুল মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায় এসব গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। ঢাকা-৪ আসনের সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নির্বাচনী এলাকা শ্যামপুর থেকে বাস-ট্রাক মিলিয়ে প্রায় ২০টির মতো যানবাহন নিয়ে আসা হয় মহাসমাবেশে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে আলম-এশিয়া পরিবহনের সাতটি বাস নিয়ে আসা হয়েছে। এর একটির সহকারী সুমন জানালেন, প্রতিটি বাস ১৪ হাজার টাকায় ঠিক করা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে রংপুর থেকে আসা চারটি বাস রাখা ছিল। এর দুটি আল ইমরান পরিবহনের, অন্যটি এমকে এন্টারপ্রাইজের। আল ইমরানের একটি বাসের চালক কালাম মিয়া জানালেন, প্রতিটি ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে এসব বাস নিয়ে আসা হয়েছে।
সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি: মহাসমাবেশে আসা গাড়িগুলো রাজধানীর হাইকোর্ট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত একপাশের রাস্তায় সারিবদ্ধ রাখা হয়। ফলে হরতালের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হয় একপাশের রাস্তা। এতে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়, ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ যাত্রীরা।
রাস্তাজুড়ে উচ্ছিষ্ট: মহাসমাবেশে আসা লোকজনকে দুপুরের খাবার হিসেবে বিরিয়ানি দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের আশপাশে রাখা যানবাহনেই এসব খাবার দেওয়া হয়। খাবার শেষে উচ্ছিষ্ট ও বিরিয়ানির প্যাকেট ফেলা হয় রাস্তায়ই। এর ফলে উদ্যানের আশেপাশের প্রায় সব রাস্তায়ই এসব পড়ে থাকতে দেখা যায়।

No comments

Powered by Blogger.