সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার মান বাড়ছে কি? by মাছুম বিল্লাহ

দেশের ৪৫ লাখ শিশুশিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের প্রথম দুই পাবলিক পরীক্ষার বৈতরণী পাড়ি দিল। ২০১৪ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ২৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। উত্তীর্ণ হয়েছে ২৬ লাখ ২৮ হাজার ৮৩ জন। পাসের হার ৯৭.৯২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৪১১ জন। এবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৪ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ২৭৩ জন। পাসের হার ৯৫.৯৮ ভাগ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৫৪১ জন। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত জেএসসিতে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৩১ জন। পাস করেছে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৭ জন। পাসের হার ৮৯.২৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমেছে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী দুপর্যায়েই। তবে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে, কমেছে শূন্যভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। এসবই ধনাত্মক সূচক।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষার মান বাড়ছে কী কমছে, তা প্রাথমিকের শিশুদের ফলাফল দেখে বলা যাবে না। তবে পিওর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ভালো করেছে। কারণ তাদের শিখন পদ্ধতি অনেক বেশি মানসম্পন্ন। তাদের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পান এবং অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন। এখানে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে শিক্ষকদের মান ও প্রশিক্ষণ। যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মান ভালো এবং শিক্ষকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সেসব বিদ্যালয়ের ফলও ভালো। অতএব প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। ২০১০ সালে এই পরীক্ষা চালু হওয়ার পর ২০১৩ সালে জিপিএ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া সাফল্য এসেছিল। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৭২ হাজার ২০৮ জন। এবার প্রথমবারের মতো গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়েছে। আর তাই গণিতে অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারেনি। সেই একই চিত্র প্রতিবছর, এতে পরিবর্তন আনার তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। শহর-গ্রাম বিভক্তি, ডিজিটাল সুবিধার দিক থেকে বিভক্তিগুলো মিনিমাইজ হচ্ছে খুব ধীরে। অতএব, সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় আবারও বেরিয়ে এসেছে- হাওর-বাঁওড়, পার্বত্য এলাকা এবং উপকূলীয় এলাকার বিদ্যালয়গুলোর পারফরম্যান্স সবচেয়ে খারাপ। এটি আমরা সবাই জানি, তারপরও বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচলিত পদ্ধতি এখানে কাজ করছে না। এসব এলাকার জন্য পৃথক ব্যবস্থা, পৃথক কাঠামো জরুরি। সেখানকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে অন্যভাবে। শিক্ষার্থীদের স্কুল টাইমিং, ছুটি, পরীক্ষা- সবই দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু আলাদা হতে হবে। তা না হলে এই বিভক্তি সহজে রোধ করা যাবে না। সরকার বিষয়টিতে
গুরুত্ব না দিয়ে দেশব্যাপী বই বিতরণ উৎসব করছে। বিনা মূল্যের বই কি সব শিক্ষার্থীর দরকার? আমাদের তো বেশি দরকার মানসম্পন্ন শিক্ষক, মানসম্পন্ন শিক্ষাদান। এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত বিনা মূল্যের বই তো খুব আকর্ষণীয় ও শিক্ষাবান্ধব হচ্ছে না।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সব সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত হলেও সেরাদের তালিকায় তারা আসতে পারছে না। তবে পিটিআই-সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় ভালো করেছে। তাদের পাসের হার ৯৯.৬২ শতাংশ। ব্র্যাক পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৯৯.৫৬ শতাংশ। ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মডেল এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশেই অনুসৃত হচ্ছে। এখানে শিক্ষকদের যেমন প্রতিমাসে রিফ্রেশার্স করানো হয়, তেমনি শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই নিয়েই ব্যস্ত থাকে না, তারা নাচ-গান-ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি-ছবি আঁকা ইত্যাদি সহ-পাঠ্যক্রমিক বিষয় নিয়মিতভাবে অনুশীলন করে থাকে। তাদের হাতের লেখাও শেখানো হয়। দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর এ বিষয়গুলোতে যথেষ্ট ঘাটতি থাকে।
গণিত ও ইংরেজি সবার কাছে কঠিন হলেও গড় পাসের চেয়ে এ দুই বিষয়ে পাসের হার বেশি। বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়। এ দুই বিষয়ে কি তাহলে গড়পড়তা নম্বর প্রদান ও খাতা সঠিকভাবে পরীক্ষণ করা হয় না, নাকি অধিকাংশ পরীক্ষক খাতায় লেখা বিষয়বস্তু না বুঝেও নম্বর প্রদান করে থাকেন? বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (পিসা) হচ্ছে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায়, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে তা পরিমাপ বা যাচাই করার পদ্ধতি। পিসার জরিপ ও মূল্যায়নে দেখা যায়, ফিনল্যান্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন শিক্ষার নেতা বা লিডার। পিসার সব ধরনের সূচকে ফিনল্যান্ড অনেক এগিয়ে আছে; আর তাই দেশটিকে শিক্ষার নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র বলে ধরা হয়। গত এক দশক ধরে ফিনল্যান্ডের এ অবস্থা এবং বিদ্যালয়গুলোয় সমতা পরিলক্ষিত হচ্ছে শিক্ষা পরিমাপের সব সূচকে। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের একটি হল সাত বছরের আগে কোনো শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না। তেরো বছরের আগে তাদের কোনো ধরনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় না এবং কোনো ধরনের হোমওয়ার্ক দেয়া হয় না। শিক্ষা শুরু করার ছয় বছরের মধ্যে পরীক্ষা তো দূরের কথা, কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। এই তিনটি সূচকের ক্ষেত্রে আমরা যদি বাংলাদেশের কথা ধরি, তাহলে আমরা কোথায় আছি? তিন বা সাড়ে তিন বছর হওয়ার আগেই শিশুদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং পাঠিয়ে দেই। সেই পাঠানো থেকেই তাকে পড়তে হয় কঠিন পরীক্ষায়। ভালো কোনো কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির জন্য শিশুকে বিসিএস পরীক্ষার মতো প্রিপারেশন নিতে হয়। বিসিএসের মতো প্রশ্ন সেট করা হয় এসব পরীক্ষায় (কোনো দেশের মুদ্রার নাম, রাজধানীর নাম, সরকার পদ্ধতি ইত্যাদি), কোচিংয়ে যেতে হয়, নির্দিষ্ট শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয়, ফলাফলের জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতে হয়, চান্স না পেলে তিরস্কার শুনতে হয়। কারণ বাবা-মা যদিও বোঝেন কিন্তু সমাজের কাছে হেয় হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা বকাঝকা করেন শিশুকে চান্স না পাওয়ার জন্য। এ নিয়ে বহু লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সরকার শিশুশ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে; কিন্তু অবস্থার কি খুব একটা উন্নতি হয়েছে?
একবার যদি শিশু তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে তো শুরু হয়ে যায় ক্লাসওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক, ক্লাসটেস্ট, সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক-সাময়িক-চূড়ান্ত-পাবলিক ইত্যাদি পরীক্ষা। এসব পরীক্ষার বেড়াজালে শিশুদের জীবন থাকে মহাব্যস্ত। জীবন ও জগৎকে তারা দেখতে থাকে অন্যভাবে। যে স্কুল যত বেশি পরীক্ষা নিতে পারে এবং শিশুদের চাপে রাখতে পারে, সেই স্কুলকে তত বেশি ভালো বলে মনে করা হয়। এ এক অদ্ভুত চিন্তা। জাতীয় পর্যায়েও আমরা চালু করেছি নতুন নতুন পরীক্ষা। সারা জীবনই যেন পরীক্ষা, আর সেই পরীক্ষা মানে মজার কিছু নয়, পুরোটাই তেতো; অথচ জ্ঞান আহরণ করা এবং করানো যে কত মজার, সেই তথ্যটিই আমরা ভুলভাবে উপস্থাপন করছি এবং প্র্যাকটিস করছি।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষার আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লো পারফরমার এবং উচ্চ পারফরমারদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত থাকে না, যা আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওএসিডি) রিপোর্ট অনুযায়ী ক্লাসটিচার ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করেন বিষয় নির্বাচন ও শিক্ষাদানে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের শেখায় তারা নিজেরা কীভাবে নিজেদের মূল্যায়ন করবে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা জানে না তারা কোন বিষয়ে কেন পড়ছে, পড়ে কতটা জেনেছে বা কতটা জানা দরকার। তারা শুধু জানে, গতবার এ প্রশ্নটি পরীক্ষায় এসেছে, এবার এটি আসবে না অর্থাৎ বেজোড় বছরের প্রশ্নপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পরীক্ষায় টপ স্কোরিং করা যায়। ওই দেশে শিক্ষকদের ডাক্তার ও আইনজীবীদের মতো সামাজিকভাবে মর্যাদা দেয়া হয়। তাই শিক্ষক হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীকে শিক্ষক প্রস্তুতি প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। তারা প্রশিক্ষণ এমনভাব পান যাতে শিক্ষার্থীদের গলদ এবং মূল রোগ নির্ণয় করতে পারেন এবং সে অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাদের প্রশিক্ষণটি হচ্ছে ক্লিনিক্যাল।
আমাদের শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের চেয়ে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, শিক্ষকদের সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় কম্পিটেন্সি ও সামাজিক দক্ষতা নির্ণয় করা যাবে। শিক্ষা যাতে বাস্তব জীবনে কাজে লাগে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। শিক্ষা ও শ্রেণীকক্ষকে কীভাবে আনন্দময় করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে, অর্থ ব্যয় করতে হবে, শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সভা-সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খাতের খরচ কমাতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষক অবশ্যই নিয়োগ দিতে হবে। আর আমাদের দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি- এমনটি অন্য কোথাও সচরাচর দেখা যায় না। আমরা বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করে দেখতে পারি।
মাছুম বিল্লাহ : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.