মাইনাস করার ক্ষমতা জনগণের অন্য কারও নয়- সঙ্কট নিরসনে খালেদার ৭ দফা

দেশের চলমান পরিস্থিতিকে চরম শ্বাসরুদ্ধকর আখ্যায়িত করে সঙ্কট সমাধানে দেশবাসীর উদ্দেশে ৭ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষনেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই সঙ্গে ৫ই জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসাবে পালনের ঘোষণা দিয়ে ওই দিন সারা দেশে সভা-সমাবেশ ও কালোপতাকা বিক্ষোভ মিছিল এবং রাজধানীতে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। জনগণ ছাড়া তাকে কেউ মাইনাস করতে পারবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, আমাকে নাকি তারা মাইনাস করে দেবে। অতীতে যারা মাইনাস করতে চেয়েছেন, তারাই মাইনাস হয়ে গেছেন। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে যে বক্তব্য দিচ্ছেন তথ্য-উপাত্ত দিয়েই বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা তার নিজের বক্তব্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল  গুলশানের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন। দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন এ বাংলাদেশের মালিকানা এখন আর জনগণের হাতে নেই। আওয়ামী লীগ বহুল বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী পাস এবং জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের খেয়ালখুশি ও সুবিধামতো একতরফাভাবে সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়েছে এবং জাতীয় সংসদ কার্যত বিরোধীদল শূন্য হয়ে পড়েছে। ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রহসন আখ্যায়িত করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, কোন বিরোধী দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয় সংসদের ৩শ’ আসনে নির্বাচন হওয়ার বিধান রয়েছে। তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৪টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে ভোটগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হলে শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি। অর্থাৎ, কেবল বিরোধী দল নয়, শতকরা ৯৫ জনেরও বেশি ভোটার ওই একতরফা নির্বাচনী প্রহসন বর্জন করে। যে তরুণেরা নতুন ভোটার হয়েছিলো তারাও ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার, সংসদ, মন্ত্রিসভা, স্পিকার ও বিরোধীদলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে পড়েছে। দেশের জনগণের কাছে এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে এই ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর মাধ্যমে জনগণ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছেন। এ থেকে যে জাতীয় সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে জনপ্রতিনিধিত্বহীন বর্তমান শাসন ব্যবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে।
খালেদা জিয়া বলেন, এই রকম একটি হীনপন্থায় ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছে। জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতা দখলের কারণে জনগণের কল্যাণ তাদের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা কোন ধরনের জবাবদিহিতে বিশ্বাস করে না। তারা বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে নাকি ৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচন করতে হয়েছে। খুব শিগগিরই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তারপর একটি বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকবৃন্দ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল সকল দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু নিজেদের দেয়া অঙ্গীকারও এখন আর আওয়ামী লীগ মানছে না। সরকারের সমালোচনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ক্ষমতার দখলদাররা আমাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চায়। দেশবাসী দেখেছে, কি ফ্যাসিবাদী কায়দায় গাজীপুরে আমাদেরকে সমাবেশ করতে দেয়া হলো না।
সমাবেশস্থলে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে একটি পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা দেয় তারা। আর প্রশাসন সেই বেআইনি সমাবেশ আহ্বানকারীদের নিরস্ত না করে ১৪৪ ধারা জারি করে। আমাদের সমাবেশ বন্ধ করে দেয়। গাজীপুরে আমাদের নেতাকর্মীরা মিছিল করতে চাইলে পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করে। অথচ পুলিশি ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীনদের সমর্থক সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে মহড়া দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। মিথ্যা মামলায় অস্থায়ী আদালতে আমি হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় আমাদের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ ও আমার গাড়িবহরের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় সশস্ত্র হামলার দৃশ্য আপনারা দেখেছেন। সশস্ত্র হামলাকারীদের নাম-পরিচয় ও ছবিসহ সংবাদ-মাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। সেই সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার দূরে থাকুক তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। অথচ আমাদের দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। বিরোধী জোট নেতা অভিযোগ করেন, আপনারা দেখছেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলোতে কিভাবে হামলা করা হচ্ছে। গত এক বছর ধরে আমরা সর্বোচ্চ সংযম বজায় রেখে সংঘাত এড়িয়ে চলছি। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদেরকে কুৎসিত ও আক্রমণাত্মক ভাষায় হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমাকে নাকি তারা মাইনাস করে দেবে। আমি মনে করি, চূড়ান্ত বিচারে মাইনাস করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। অতীতে যারা মাইনাস করতে চেয়েছেন, তারাই মাইনাস হয়ে গেছেন। আর রাজনীতি থেকে আমাকে মাইনাস করার সিদ্ধান্ত একমাত্র দেশবাসী নিতে পারেন। অন্য কেউ নন। যারা হুমকি দিচ্ছে তারা তাদের ফ্যাসিবাদী চেহারাই সকলের সামনে তুলে ধরছে। দেশবাসীই যথাসময়ে তাদের উপযুক্ত জবাব দেবে।
খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের জনগণের সকল মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। সমাবেশ ও প্রতিবাদের অধিকার রহিত করা হয়েছে। তারা সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করেছে বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোকে পুরোপুরি কব্জায় নিতে। দলীয়করণ ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া বিচার বিভাগকে পূর্ণনিয়ন্ত্রণ করার হীন লক্ষ্যে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য আইন পাস করেছে। তিনি বলেন, যারা সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ করছে তাদের ওপর নগ্ন হামলা চালিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং গুম ও খুন করে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে। মাঠে-ময়দানে এমনকি হলরুমে পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও প্রতিবাদী জনগণকে দাঁড়াতে বাধা দেয়া ও হামলা করা হচ্ছে। সবখানে বিএনপি, ২০ দল ও অন্যান্য বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালাতে প্রকাশ্য উস্কানি ও নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। দেখামাত্র গুলি করার আদেশ দিয়ে আজ তারা জনগণের মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করছে। আইনের শাসন এখন পুরোপুরি নির্বাসিত। রাজনীতির ভাষাকে এরা কলুষিত করে সন্ত্রাসীর ভাষায় পরিণত করেছে। তারা সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের ভাষায় কথা বলছে। আমি বলতে চাই, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আগামীতে আরো সরকার আসবে। এখন আপনারা যেসব অপকর্ম করছেন, যেমন আচরণ করছেন, তার প্রতিফল আগামীতে ভয়ঙ্কর হতে পারে। কাজেই বুঝে শুনে কথা বলবেন ও কাজ করবেন।
খালেদা জিয়া বলেন, তাদের সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখল, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, হামলা, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান প্রভৃতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো জনগণের কাছে ধিকৃত হতে হতে এখন বিভীষিকা ও মূর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে ১১ খুনের নৃশংস ঘটনার পর র‌্যাব সদস্যদের কার্যকলাপ এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আমরা এ কারণেই র‌্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছি।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশে আজ যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে অবস্থার অবসান ঘটানো না গেলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই সংকট উত্তরণে অনতিবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ, ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে সরকার গঠনের কোন বিকল্প নেই। এসময় দেশবাসীর উদ্দেশে সাতদফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।
প্রস্তাবগুলো হলো-
১. জাতীয় সংসদের নির্বাচন অবশ্যই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। যাতে সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সকল পক্ষের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুযোগের সমতা নিশ্চিত হয়।
২. নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। যাতে, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যায়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায় থেকে পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা যায়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তব্যে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়। সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়। এবং ভোটার তালিকার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা সম্ভব হয়।
৩. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিক্রমে গঠিত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
৪. নির্বাচনের উপযোগী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারিখ ঘোষণার পরপরই বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে। ৫. নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত হিসাবে চিহ্নিত সদস্যদের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার এবং কর্তব্যপালন থেকে বিরত রাখতে হবে।
৬. সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাসমূহ প্রত্যাহার করতে হবে। ৭. বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া সকল সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দিতে হবে। মাহমুদুর রহমানসহ আটক সকল সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে।
৫ই জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসাবে পালনের ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন,  গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ওই দিন সারা দেশে সভা-সমাবেশ ও কালোপতাকা বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে ঢাকায় আমরা একটি কেন্দ্রীয় সমাবেশ করতে চেয়েছি। আশা করি আমাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে দেয়া হবে। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচিকে অগ্রসর করে নিতে চাই। পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি আসবে। বাধা দিয়ে, আক্রমণ করে জনগণের আন্দোলনকে কেউ কখনও দমাতে পারেনি। এবারও পারবে না।
দেশবাসীকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের দলমতের পার্থক্য আছে। সকলেরই নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পৃথক ভাবনা ও কর্মসূচি আছে। কিন্তু দেশ রক্ষায়, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনতে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলকে আজ একমত হতে হবে। আমি সকলকে এক প্লাটফরমে এসে কিংবা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আরএ গণি, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রি. জে. (অব.) আসম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সারওয়ারী রহমান, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপরসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। ২০ দলের নেতাদের মধ্যে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান,  কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাতীয় পার্টি (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, এনপিপির সভাপতি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ন্যাপের জেবেল রহমান গাণি, মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান এএইচএম কামরুজ্জামান খান, ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি সাইফুদ্দিন মনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
১৫ প্রশ্নের জবাব খালেদার: ৫ই জানুয়ারির আগে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ সরকার দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে কোন লিখিত অঙ্গীকার করেছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের সামনে আওয়ামী লীগের নেতারা যে কথা বলেছেন সেটা কি অঙ্গীকার নয়? তবে সেখানে কোন লিখিত অঙ্গীকার করেনি। তারানকো দুই পক্ষকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সে নির্বাচনের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মন্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাজাকার ছিলেন, এর সঙ্গে খালেদা জিয়া একমত কিনা জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, তারেক রহমান নিজে থেকে কিছু বলেননি। আর তিনি যা বলেছেন, ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই বলেছেন। ৭ দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে বিএনপি কবে নাগাদ নির্বাচন চাইছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমরা বারবার বলেছি- যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের কথা। বর্তমান সরকার অবৈধ তারা যত দ্রুত নির্বাচন দেয় ততই দেশের জন্য ভাল। রাজনীতি কৌশলের খেলা হয়ে জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন থাকার পরও কেন সরকারের কৌশলের সঙ্গে পেরে উঠছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, রাজনীতি কৌশলের খেলা ঠিক তবে অপকৌশলের নয়। সরকার তো অপকৌশল করছে। তারা আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এমন কি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও সাহস পায় না তাই পুলিশের ছত্রচ্ছায়া এসব হামলা করে। ৭ দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য আলোচনা যদি করতেই হয় তবে যারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে তাদের সঙ্গেই তো করতে হবে। আমরা সেই জন্য এ প্রস্তাব দিচ্ছি, এটা কোন ইঙ্গিত নয়। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে নাকি ২০দল নতুন ফর্মুলা দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো বলেছি- নির্বাচন করতে হলে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। ৭দফা প্রস্তাব আলোচনার জন্য নাকি আন্দোলনের জন্য এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, সরকার জনগণের বাইরে নয়। এ প্রস্তাব তাই সরকারের জন্যও। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা কি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আলোচনায় আসবে নাকি আন্দোলনের দিকে যাবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়ে সমালোচনার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা তো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো আন্দোলন এবং নির্বাচন সবই করেছে। তখন আপনারা দেখেননি, আপনাদের সমালোচনা তো তখন ছিল না। গুলশানের বাসা ও কার্যালয় ছেড়ে খালেদা জিয়া কবে জনগণের কাতারে আসবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সবসময় জনগণের কাতারেই ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকবো। যখন সময় হবে তখন রাজপথে নামবো। আন্দোলনের জন্য বিএনপি সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি একটি বড় ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। আমরা একবছর ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। কর্মসূচিতে নেতাদের রাজপথে দেখা যায় না, কাদের নিয়ে আন্দোরন করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের নেতারা রাজপথে থাকে। নেতারা রাজপথে থাকে না এটা এজেন্টদের খবর। গণমাধ্যমও সম্ভবত বাধ্য হয়ে এসব খবর ছাপে। তিনি উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন, আন্দোলনে রাজপথে না থাকলে নেতাদের নামে মামলা হয় কেন? তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবৈধ। সবার অংশগ্রহণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আমার একার নয়। দেশের জনগণ, সকল রাজনৈতিক দল, বিদেশীরাও সরকারের প্রতি একই দাবি এবং আহ্বান জানাচ্ছেন। ২০দলের আন্দোলনে বিদেশীদের সমর্থন আছে কিনা এবং তারেক রহমান আন্দোলনে যুক্ত হবেন কিনা জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে বিদেশীদের কোন যোগসূত্র নেই। আর তারেক রহমান এখনও অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসাধীন। জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের ব্যাপারে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে বিশ্বাস করে না। সরকারের লোকজনই এসব নৈরাজ্য করে। আপনাদের কি মনে হয় কারা গাড়িতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়েছিল। আসলে সরকারের অপকৌশল হিসেবে এসব নৈরাজ্য ঘটিয়ে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়।  রাজবন্দিদের মুক্তির যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বন্দিরাও আছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা রাজবন্দিদের কথা বলেছি। আর সাজার ব্যাপারে আমাদের অবস্থানও পরিষ্কার। বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ।

No comments

Powered by Blogger.