নতুন বছর মঙ্গল বয়ে আনুক

আজ দেশ-বিদেশে নববর্ষ নিয়ে ঘটবে নানা বর্ণালী অনুষ্ঠান। বস্তুত এগুলোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন থেকেই। একবার থার্টিফার্স্ট নাইটে বড়ই আনন্দের সুযোগ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। স্ত্রী, ছেলে, নাতি-নাতনি এবং পরিচিত অনেকেসহ। বেশ অনেক রাতে একটি গাড়িবহর নিয়ে চলে গেলাম সিডনির মূল সিটি এলাকায়। ঐতিহাসিক সেতু পার হয়ে যখন পৌঁছলাম প্রশান্ত মহাসাগর তীরে বিশাল মাঠটিতে তখন অবাক হয়ে দেখলাম রঙবেরঙের অজস্র আতশবাজি অনবরত এদিক-ওদিক-সেদিক থেকে ছোড়া হচ্ছে মহাশূন্যে। সেটা ছিল ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের থার্টিফার্স্ট নাইট।
থার্টিফার্স্ট নাইট তো একটি বছরের শেষ বিদায়ের রাত। কিন্তু কোনো কিছুর বিদায় তো দুঃখের বলে সাধারণ জ্ঞানে আমরা জানি। তাহলে কেন এমন উৎসবের আয়োজন ওই রাতেই? এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক কারণ আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে নিজে নিজেই নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি তা হল পুরাতনের বিদায়ের মধ্যেই তো নতুনের শুভাগমন। তাই নতুনকে সমারোহ করে স্বাগত জানানো হবে তেমনি আবার পুরাতনকেও তেমনই সমারোহ করে বিদায় জানাতে হবে।
আর একটি বছরের সমাপ্তি তো অনেকাংশেই একটি ইতিহাসের সমাপ্তি। তাই ইতিহাস সমাপ্ত হলে বা ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে বর্ষশেষকে তো গুরুত্ব¡ দিয়েই উদযাপন করতে বা মনে রাখতে হবে। তাই এ ব্যাপক আয়োজন। অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশাল জনমানবহীন দেশের ওই মাঠটিতে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে জমায়েত হয়েছিলেন হাজার নর-নারী, তরুণ-তরুণীর, যুবক-যুবতীর সংখ্যাই যদিও বেশি তবুও তারাই সব নন। অন্যান্য বয়সী, বিশেষ করে বয়সীদের সংখ্যাও তো নেহায়েত কম ছিল না। সবাই মিলে কি উদ্দাম নৃত্য। তরুণীরা একজনের সঙ্গে থাকছে- শেষ হতেই আর একজনের সঙ্গে। ওমা, শেষে দেখি যে আমি বা আমার স্ত্রীও বাদ পড়লেন না। সবাইকে নাচতেই হল জোড়ায় জোড়ায়? ড্রিংক? হ্যাঁ, তাও। বাদ নেই, রেহাইও নেই। কারণ কোনো কিছুতে অস্বীকৃতি জানানো নেহায়েত শিষ্টাচারবহির্ভূত বলেও গণ্য হয়। এভাবে আলোর ঝলকানি নাচ-ড্রিংকস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শেষ হল থার্টিফার্স্ট নাইট। না তাই বলে নারীর সম্ভ্রমহানি নেই, অপহরণ নেই, গুম নেই, নেই অমর্যাদাকর কোনো কিছুই।
অবশেষে ভোর হল। নববর্ষের নতুন প্রভাত। সবাই জমায়েত হলাম এক জায়গায়। সেখানেও ড্রিংকস যেন তাই দিনেই নববর্ষের আবাহন। বাইরে আরও অনেক আয়োজন ছিল, গেলাম না অন্য কোথাও নববর্ষ অনুষ্ঠান দেখব ওই বাসা থেকে সোজা বড় ছেলে প্রবীরের বাড়িতে এসে ঘুম। তবে যেটুকু করা হল, তা মনে রাখার মতো।
আমেরিকায় যাইনি কোনো দিন। তবে নববর্ষ উৎসব সেখানেও পালিত হয় পৃথিবীর সব দেশের মতোই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এবং নানারকম উদ্দামতার মধ্য দিয়ে মিডিয়া মারফতে তা জানা যায়। তবে যত যাই হোক নববর্ষ উদযাপনে আমরা বাঙালিরা, আমার বিবেচনায় ও রুচিতে, ফার্স্ট, অদ্বিতীয়, রমনার বটমূলের অপূর্ব অনুষ্ঠানমালা, অপরাপর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানাদি। নানা মিডিয়ার, বিশেষত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোর নানাবিধ আয়োজন বস্তুতই বাঙালি সংস্কৃতির এক অনবদ্য পরিবেশনা সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। ইলিশ-পান্তা, মুখ-মিষ্টি করা বা করানো, বৈশাখী মেলা, সবকিছু মিলিয়ে সেদিনটি নেহায়েতই আমাদের বাঙালিদের। একান্তভাবেই নিজস্ব।
কিন্তু বাঙালি জাতি মূলত রাজনীতিপ্রবণ। রাজনীতি করতে, রাজনীতি জানতে ও শুনতে ভালোবাসে। ২০১৪ সালের রাজনীতি জনগণকে উৎসাহিত করতে পারেনি। জানুয়ারির ৫ তারিখে নির্বাচনটি ছিল যেমন অতিমাত্রায় বিতর্কিত ক্ষমতাবহির্ভূত দলগুলোর অংশগ্রহণহীন, তেমনি একতরফা বা একদলীয় সংসদে নেতা-নেত্রীদের পরস্পর পরস্পরকে গালিগালাজ এবং নিন্দা-ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির অনুকূল। বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে বিদেশে অবস্থানকারী তারেক রহমানের নানাবিধ আপত্তিকর উক্তির প্রতিবাদে সরকারি দলের এবং ওই উক্তির সমর্থনে বিএনপির প্রতিক্রিয়া যে প্রবল উত্তেজনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে নতুন করে মানুষের মনে নানাবিধ ভীতি এবং শংকারও সৃষ্টি হয়েছে। আবারও হরতাল-অবরোধ? অবাক ওই হরতাল-অবরোধ ডাকতে বিএনপিকে যেন সরকারি মহল থেকেই উসকানিও দেয়া হল। মাঝখানে ১৬ কোটি মানুষের অসহায়ত্ব, দুঃখ-কষ্ট, জীবনের নিরাপত্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা সবই নতুন করে অনিশ্চয়তার হুমকিতে পড়ে গেল।
কেন এমনটি হল? দুই নেত্রীর এবং তাদের সাগরেদদের পারস্পরিক অশ্রদ্ধাশীল অবমাননাকর বক্তব্য তো সারা বছর ধরে নানা উসকানি দিয়েছে, লন্ডন থেকে জিয়াতনয় তারেকের নানা দম্ভোক্তি অগ্নিতে ঘৃতাহুতিও দিয়েই এসেছে। কিন্তু সর্বশেষ তারেকের জঘন্য ইতিহাসবিরোধী ও নোংরা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে যে চরম অশ্রদ্ধাসূচক বক্তব্য দিয়ে দেশটাকে তাতিয়ে তোলা হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলও মাত্রাতিরিক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন দাবি করা হল তারেককে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে নতুবা বাংলাদেশের কোথাও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সভা-সমিতি-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। বিএনপির ঘোষিত জনসভা ছিল ২৭ ডিসেম্বরে গাজীপুরে। ছাত্রলীগ বলে বসল খালেদা জিয়াকে গাজীপুরে সভা করতে দেয়া হবে না। ছাত্রদল-যুবদল বলল, গাজীপুরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার জনসভা হবেই, ছাত্রলীগকে তারা মোকাবেলা করবে।
এবারের ছাত্রলীগের দাবির সমর্থনে এগিয়ে এলো প্রশাসন। তারা জারি করে দিলেন ১৪৪ ধারা মোতাবেক নিষেধাজ্ঞা যাতে খালেদা জিয়া জনসভা করতে না পারেন। অপরদিকে বোকার মতো বিএনপি খালেদা জিয়ার গাজীপুর জনসভা বাতিল ঘোষণা করে কাপুরুষের মতো ভূমিকা নেয়ায় দেশব্যাপী বিধৃত হল। সম্ভবত তাই তারা সোমবার দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করেন এবং আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়ার কথাও হুশিয়ারি দ্বারা দেশবাসীকে জানিয়ে দেন।
এখানেই শংকা, এখানেই ভয়। অর্থাৎ বিগত বছরটি বাগবিতণ্ডার মধ্য দিয়ে চললেও নাগরিক জীবন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। সেই শান্তিটুকুও উধাও হতে পারে বলে তাবৎ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আবার অবরোধের হুমকিও বিএনপির তরফ থেকে দেয়া হয়েছে। তা নিয়েও উদ্বেগ কম নয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের ওই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননাকর উক্তির প্রতিবাদে সারা দেশে নানা আদালতে অসংখ্য মোকদ্দমা করা হয়েছে। অনেক আদালত মোকদ্দমাগুলোর প্রাথমিক শুনানির পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। বাকি আদালতগুলো সমন জারি করে বসে আছেন। তারেক গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলো দেখে আরও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, আরও বেশি আবোল-তাবোল যে বলতে থাকবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ তিনি বসে আছেন নিরাপদ দূরত্বে। সেখানে যে বাংলাদেশের পুলিশ গিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন না, তা তো তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। ভোগান্তি যা হওয়ার তা হবে এবং হচ্ছে বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের।
তাই এ ধরনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ। এর দ্বারা দেশ ও জনগণ লাভবান হয় না, হচ্ছেও না। কিন্তু তারা তো অসহায়। বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেনি সহসা ঘটবে এমন কোনো সম্ভাবনা এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মানুষ তার প্রত্যাশী। তারা অন্তত এটুকু বুঝে ফেলেছেন, দেশের প্রধান দুটি দল যে অপরাজনীতিতে শুধু নিজেরা ক্ষমতায় থাকা বা খাওয়ার জন্য মেতে উঠেছেন তার দ্বারা দেশবাসীয় কোনো কল্যাণ সাধিত হবে না। তাই প্রয়োজন একটি বিকল্প বামধারার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির। যে শক্তি ব্যক্তি বা দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবেন- শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী, সুন্দর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে আপ্রাণ নিয়োজিত থাকবেন। ২০১৫ সালে সেই শক্তির উত্থান ঘটুক- কামনা এমনটাই।
কী করে ভুলে যাওয়া যাবে বকশিবাজারের সাম্প্রতিক ঘটনা? সেখানে খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়া নিয়ে কি মারাত্মক ঘটনাই না ঘটল। খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে ছাত্রদল তাদের সাধ্যশক্তি অনুযায়ী বিশাল জমায়েত গড়ে তুলেছিল। ছাত্রলীগ কোত্থেকে আবির্ভূত হল, ততোধিক শক্তি নিয়ে হাজির হয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আক্রমণ করল ছাত্রদল-যুবদলের নেতা কর্মীদের। ছাত্রলীগ নেতার পিস্তল তাক করে থাকার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হল। পত্রিকাগুলো সে কথা লিখলে সঙ্গে সঙ্গেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে উঠলেন, না ছাত্রলীগ তো ওখানে যায়ইনি। যা করেছে সবই ছাত্রদল-যুবদলের লোকেরা। ব্যাস আর যায় কোথাও পুলিশ ছুটল যারা গুলি খেল তাদের ধরতে, ধরলও বটে। ধরা দূরে থাকুক অপরাধী হিসেবে একটি মামলাও করল না পুলিশ ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে। যেন ছাত্রলীগ কখনও কোনো অপরাধ করে না। এমন আরও দলবাজি আরও বহু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে। স্থানাভাবে সে পাঁচালি নিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া সম্ভব নয় বলেই তা থেকে বিরত থাকতে হল। তাদের জন্য শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কত কিই না দেখতে হচ্ছে।
১৬ কোটি মানুষ ২০১৫ সালে কল্যাণকর বিষয়গুলোকেই দেখতে চায়- চায় একটি গণমুখী ইতিবাচক পরিবর্তন।
২০১৫ রাজনীতির ময়দান হোক কলুষমুক্ত। দুর্নীতিমুক্ত, দলবাজিমুক্ত। প্রতিষ্ঠিত হোক আইনের শাসন। জামায়াতে ইসলামী সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হোক, মানুষের আয়ের ব্যবধান হ্রাস পাক, বেকারত্ব দূর হোক- এসব আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী দেশের মানুষ।
রণেশ মৈত্র : প্রবীণ সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.