৮ দিনে সিলেটেই ক্ষতি ২০০ কোটি টাকা by ওয়েছ খছরু

টানা অবরোধে দারুণ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের জ্বালানিখাত। পেট্রলপাম্পগুলোতে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল সঙ্কট চরমে। তেল না থাকায় আজকালের মধ্যে শুরু হবে হাহাকার। এতে সিলেটের জ্বালানি ব্যবসায়ীদের প্রতিদিন অর্ধশত কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। ওদিকে, সিলেটের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কূপগুলো থেকে উত্তোলিত তেল বাজারে আনা যাচ্ছে না। এতে করে তেল ও গ্যাসকূপের মধ্যেই আটকা পড়ে আছে জ্বালানি। জ্বালানি ব্যবসায়ীরা বলছেন, অবরোধে জ্বালানি পরিবহন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। একটি ককটেল কিংবা পেট্রল বোমার ছোঁয়া পেলেই জ্বালানি পরিবহনের যানবাহন সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যাবে। আর ওয়াগনবাহী ট্রেনও সহিংসতার কারণে চলছে না। এ কারণে অবরোধে জ্বালানি পরিবহন নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে প্রশাসন। গত দুইদিন জ্বালানি ব্যবসায়ীরা সিলেটের জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে  বৈঠক করেও কোন ঝুঁকিমুক্ত পদ্ধতি খুঁজে পায়নি। তবে, আপাতত সিলেটের জ্বালানি সঙ্কটের কিছুটা মেটাতে প্রশাসনের পাহারায় কৈলাশটিলা কূপে থাকা গাড়িগুলো সিলেটে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। বর্তমান রাজনৈতিক দুর্যোগময় পরিস্থিতির শুরু থেকেই সিলেটে জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেয়। প্রতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনের ওয়াগনে করে অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল নিয়ে আসা হয় সিলেটে। ওখানে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তিনটি ডিপোতে তেল সংরক্ষিত করে বিভাগের ১৬৭টি পেট্রল ও সিএনজি পাম্পে বিক্রি করা হয়। কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৈলাশটিলা গ্যাসকূপে পাওয়া তেল দিয়ে সিলেটের বাজারে চাহিদা পূরণ করা হয়। সিলেটের পেট্রলপাম্প মালিকরা জানিয়েছেন, চলমান অবরোধের মধ্যেও সিলেটে প্রায় ১০ লাখ লিটার ডিজেল, ৩ লাখ লিটার পেট্রল ও ১ লাখ লিটার অকটেনের চাহিদা রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এই চাহিদা কখনো কখনো দ্বিগুণ হয়। তারা জানান, ৪ঠা জানুয়ারি থেকে দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে সিলেটে চট্টগ্রাম থেকে কোন ওয়াগনবাহী ট্রেন আসেনি। পথিমধ্যে সহিংসতা কিংবা ট্রেন জ্বালিয়ে দেয়ার আশঙ্কায় ওয়াগনবাহী ট্রেন আসা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে গত ৪দিন ধরে সিলেটের শতাধিক পেট্রলপাম্পে জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেয়। কোথাও কোথাও চলছে হাহাকার। চাহিদামতো জ্বালানি সরবরাহ করতে পারেননি  পেট্রলপাম্প মালিকরা। গতকাল থেকে এ সঙ্কট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। পেট্রোলিয়াম ওনার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা গতকাল জানিয়েছেন, অবরোধে যেহেতু জ্বালানি পরিবহন করা ঝুঁকিপূর্ণ এরপরও সিলেটের পাম্প মালিকরা অনেকটা ব্যবসায়ীক ঝুঁকি নিয়ে গত কয়েকদিন আশুগঞ্জ থেকে জ্বালানি এনেছেন। কিন্তু আশুগঞ্জ থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যে তেল পাওয়া যাচ্ছে সেটি চাহিদার দশ ভাগের এক ভাগও পূরণ হয় না। এর ফলে একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে সিলেটের পেট্রলপাম্প। তারা জানিয়েছেন, জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তারা ইতিমধ্যে সিলেটের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পেট্রোলিয়াম ডিপো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। কিন্তু এসব বৈঠকে ডিপো কর্তৃপক্ষ কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তারা জানান, অবরোধে জ্বালানি পরিবহনে ঝুঁকি থাকায় মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপো সিলেটের কর্মকর্তারা সার্বিক সহায়তা চেয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে পত্র দিয়েছেন। কিন্তু পত্র দেয়ার পরও কোন সদুত্তর মিলেনি। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ডিপোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম থেকে ওয়াগনবাহী ট্রেন না আসার কারণে তারা জ্বালানি সঙ্কটে পড়েছে। এ জন্য চট্টগ্রাম থেকে যাতে ওয়াগনবাহী ট্রেন সিলেটে আসতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইতিমধ্যে প্রশাসনকে লিখিত অবগত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কিংবা সরকার সে ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছেন না বলেও জানান তারা। পত্রের কোন সদুত্তর না পেয়ে রোববার বিকালে সিলেটের জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনটি ডিপোর কর্মকর্তা, সিলেট বিভাগীয় পেট্রোলিয়াম ওনার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে ডিপোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ওদিকে, গতকাল এ নিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তারা। সিলেট পেট্রোলিয়াম ওনার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা সহ পরিবহন খাতের নেতারাও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক  থেকে বেরিয়ে এসে সিলেট বিভাগীয় পেট্রোলিয়াম ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জামান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পুলিশের সহায়তা চাওয়া হলেও বাস্তবে কোন ফল আসবে কিনা সন্দেহ।  কৈলাশটিলায় আটকা পড়া জ্বালানিবাহী লরি সিলেটে নিয়ে আসতে পুলিশ সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু ওই তেল সিলেটে আনা হলেও নগরীর আংশিক চাহিদা পূরণ হবে। বিভাগের অন্যান্য স্থানে সব পেট্রলপাম্পগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এ জন্য চট্টগ্রাম থেকে ওয়াগনবাহী ট্রেনকে সিলেটে নিয়ে আসতে হবে। আর সেটি সরকারকেই করতে হবে বলে জানান। তিনি এব্যাপারে সরকারের উচ্চ মহলের সহায়তা কামনা করেন। এদিকে, সিলেটের প্রায় ৮০ ভাগ পেট্রলপাম্প গতকাল থেকে জ্বালানি সঙ্কটে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট সিএনজি পাম্প মালিক এসোসিয়েশনের সভাপতি জুবায়ের রহমান আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, জ্বালানি সঙ্কট থাকার কারণে পরিবহন রাস্তায় নামতে পারছে না। দিন দিন এ সঙ্কট আরও প্রকট হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে গোটা দেশেই জ্বালানিখাত দুর্দিনে পড়বে বলে জানান তিনি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তেল দিয়ে সিলেটের চাহিদা ২০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছে পেট্রলপাম্প মালিকরা। সিলেটের গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা পাম্প থেকে তেল সংগ্রহ করা হয়। পরে ট্যাঙ্কলরি দিয়ে সে জ্বালানি নিয়ে আসা হয় সিলেট সহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। অবরোধের কারণে গত ৪ঠা জানুয়ারি থেকে কৈলাশটিলায় আটকা পড়েছে জ্বালানি পরিবহনের শত শত ট্যাঙ্কলরি। ওই ট্যাঙ্কলরিগুলো গোলাপগঞ্জের একটি অস্থায়ী স্ট্যান্ডে আটকা আছে। অরক্ষিত অবস্থায় থাকা ওই ট্যাঙ্কলরি সিলেটে নিয়ে আসতে পুলিশ সহায়তা প্রয়োজন। গতকাল পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে এব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এদিকে, অবরোধের কারণে সিলেটের পেট্রল ও সিএনজি পাম্প মালিকদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিএনজি পাম্প মালিক এসোসিয়েশনের সভাপতি জুবায়ের আহমদ চৌধুরী। তার হিসাব মতে গত ৮ দিনে এ খাতে সিলেটেই ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.