নেতাদের না পেয়ে স্বজনদের গ্রেপ্তার by কাফি কামাল ও কাজী সুমন

দেশব্যাপী চলছে গণগ্রেপ্তার। আন্দোলন দমাতে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোথাও কোথাও চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান। নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আত্মীয়স্বজনকে। এমনকি বিএনপি নেতাদের বাড়িভাড়া দেয়ার অভিযোগে বাড়ির মালিককেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নেতাদের পরিবারের সদস্যসহ বাড়ির কাজের লোকদের মারধর ও দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাঙচুর করা হচ্ছে বাসার আসবাবপত্র। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় গত দুই সপ্তাহে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন বিরোধী জোট নেতারা।
রাজধানীর চিত্র: গত ১৮ই জানুয়ারি রাতে ডিবি পুলিশের একটি দল তল্লাশি চালায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের রাজধানীর আদাবরের ভাড়া বাসায়। এসময় রিজভী আহমেদকে না পেয়ে বাড়ির মালিক মোস্তাফিজুর রহমান, মারজান ও নিরাপত্তা কর্মী শাহেদকে নিয়ে যায়। রিজভী আহমেদের স্ত্রী আরজুমান আরা জানান, রোববার রাত সাড়ে দশটার দিকে মহানগর ডিবি পুলিশের একটি দল রিজভীকে খোঁজ করতে আসে। এসময় বাড়ির মালিকের কাছে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে করা চুক্তিপত্র দেখতে চায় ডিবি পুলিশ। এছাড়া বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদকে কেন বাড়িভাড়া দেয়া হয়েছে তাও জানতে চান তারা। পরে বাড়ির মালিক ও নিরাপত্তা কর্মীসহ তিন জনকে নিয়ে যায় পুলিশ। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রিজভী আহমেদের স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ, অভদ্র ভাষায় গালিগালাজ এবং বাসার আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এদিকে গত ১৪ই জানুয়ারি ঢাকা মহানগর যুবদল দক্ষিণের সভাপতি হামিদুর রহমান হামিদের বাসা এবং কার্যালয়ে ভাঙচুর ও তল্লাশির অভিযোগ করা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ তল্লাশির নামে ব্যাপক ভাঙচুর করে এবং কার্যালয়ের কর্মচারী সেলিম ও আলীকে মারধর করে পুলিশ। ১৬ই জানুয়ারি হামিদের খোঁজে তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। এসময় পিটিয়ে নিরাপত্তা রক্ষী রুবেলের হাত ভেঙে দেয়া হয়। এছাড়া হামিদের বয়স্ক মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে এসময় হামিদ বাসা বা কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন না। যুবদল নেতা মামুন জানান, গত ১৮ই জানুয়ারি রাতে রাজধানীর শিল্পাঞ্চল থানা যুবদলের সভাপতি রিয়াদের বাসায় তল্লাশি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসময় পরিবারের সদস্যদের মারধর ও দুর্ব্যবহার করে তারা। রিয়াদকে না পেয়ে ছোটভাই ফুয়াদকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। গত ১৭ই জানুয়ারি রাতে পুলিশ তল্লাশি চালায় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরবের শ্বশুরের নাখালপাড়ার বাসায়। এসময় বাসার আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তছনছ করা হয়। মারধর করা হয় পরিবারের সদস্যদের। নিরবকে না পেয়ে তার শ্যালক রিংকুকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ১৬ই জানুয়ারি রাতে শেরেবাংলানগর থানা যুবদল সভাপতি সালামত খান সগীরের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। এসময় সগীরকে না পেয়ে ভগ্নিপতি আরিফ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েলের পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জুয়েল বলেন, কিছুদিন আগে আমার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। আর রাজনৈতিক কারণে আমি নিজ বাসায় অবস্থান করি না। ফলে পুরো বাসাতেই পুরুষশূন্য আমার বৃদ্ধা মা ও খালা অবস্থান করছেন। আর পুলিশের তল্লাশির সময় মা ও খালাকে হয়রানি করা হয়েছে। এ সময় তারা ভাঙচুর চালায় বলেও অভিযোগ করেন জুয়েল। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী জানান, কয়েকদিন আগে মিরপুর থানা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ফিরোজ আলমের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় তাকে না পেয়ে তার পিতাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এছাড়া ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের বাসায়ও একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এ সময় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। ওদিকে গত ৩ থেকে ২০শে জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসায় কয়েকদফা অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পুলিশ। কয়েকদিন আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার সাজেদা আলী হেলেনের ছেলের খোঁজে তার রমনার বাসভবনে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় তাকে না পেয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও বাসা তছনছ করে।
রাজধানীর বাইরের চিত্র: অবরোধের মিছিলে অংশগ্রহণের সময় চট্টগ্রাম মহানগর থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আহ্বায়ক লায়ন আসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার দুই ভাই আজম চৌধুরী ও আমজাদ হোসেন চৌধুরীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হয়রানি করছে পুলিশ। গত দুই সপ্তাহে আগে ফেনী শহর বিএনপির সভাপতি আলালউদ্দিন আলালের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় আলালকে না পেয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং আলাউদ্দিন ও বাঁশি নামে দুইজন কাজের লোককে ধরে নিয়ে যায়। এছাড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন মামুনের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তাকে না পেয়ে তার বড় ভাই খোকনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে এলাকাবাসীর হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে ২০শে জানুয়ারি রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের আহবায়ক মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় লোহার রড দিয়ে বাড়ির কলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করে। ভেতরে ঢুকে তৈমূর আলমকে না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। গালাগালি করতে বারণ করলে গাড়িচালক সেলিমকে মারধর করে পুলিশ সদস্যরা। যাওয়ার সময় মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয় এক পুলিশ সদস্য। এর আগের রাতে পুলিশ তল্লাশি চালায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রেজা রিপনের বাসায়। তাকে না পেয়ে তার বোন ডা. জাকিয়া পারভীন লিপির বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। একপর্যায়ে এসপি পদমর্যাদায় এক পুলিশ কর্মকর্তা ডা. জাকিয়া পারভীনকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন। এসময় তিনি বলেন, আমার ভগ্নিপতি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমি একজন ডাক্তার। আমার সঙ্গে আপনি যে দুর্ব্যবহার করছেন সেটা আমি উনাকে বলতে বাধ্য হবো। এরপর পুলিশ সদস্যরা চলে যান। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সভাপতি শামা ওবায়েদ বলেন, রাজধানীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দলের নেতাদের বাসায় ও ফরিদপুরে আমার নির্বাচনী এলাকায় একাধিক নেতার বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালানোর সময় পরিবারের সদস্যদের সময় দুর্ব্যবহার করেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মসিউর রহমান জানান, নেতারা তো বটেই কর্মীরাও পুলিশি হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতি গ্রামে বিএনপির এক সমর্থকের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় তাকে না পেয়ে তার পিতাকে ধরে নিয়ে যায়। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী জানান, অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীসহ সারাদেশে ছাত্রদলের সিনিয়র নেতাদের বাসা-বাড়িতে অভিযান ও তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের আটক, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও বাড়িঘর তছনছ করা হচ্ছে। ৩রা জানুয়ারি মধ্যরাতে নরসিংদীতে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ ফকিরের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় তাকে না পেয়ে তার মা-বাবা ও দুই গৃহকর্মীকে আটক করে যৌথ বাহিনী। এ সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা বাড়ির আসবাব ভাঙচুর করে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে চাঁদপুর জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ফয়সাল গাজী বাহারের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় তাকে না পেয়ে তার বাবা ও বোন জামাইকে ধরে নিয়ে যায়। ১৭ই জানুয়ারি মাদারীপুর জেলা ছাত্রদরের সাধারণ সম্পাদক অহিদুজ্জামান খানের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। অহিদকে না পেয়ে তার মাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার মাদারীপুরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে জেলা ছাত্রদল। একইভাবে রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ওয়ালীউজ্জামান পরাগ, সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রদল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বাসাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। ওদিকে নেত্রকোনা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের তালুকদার অভিযোগ করেন, গত শনিবার গভীর রাতে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান খান রেজভী, ইমরান খান চৌধুরী, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মজিবুর রহমান খান, পৌর বিএনপির সম্পাদক আনিসুল হক খান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক কাউসার আহম্মেদসহ প্রায় ২০-২৫ জন  নেতাকর্মীদের বাসায় তল্লাশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসময় বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এদিকে এ ঘঠনায় উল্টো বিএনপির সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এদিকে গত ১৫ই জানুয়ারি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। সকাল থেকে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি’র সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর একাধিক দল বিভক্ত হয়ে অভিযান শুরু করে। অভিযানে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশির নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাই হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় পুরো এলাকা এখন পুরুষশূন্য। এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.