ফের গুম আতঙ্ক

দেশব্যাপী ফের দেখা দিয়েছে গুম আতঙ্ক। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বেশ কয়েকজন নিখোঁজ হয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। নিখোঁজের পর লাশ পাওয়া গেছে কারো কারো। এতে বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক। গুমের শিকার হচ্ছেন নারী সদস্যরাও। হয়রানির ভয়ে অনেকে গণমাধ্যমকে জানাচ্ছেন না স্বজন নিখোঁজের তথ্য। টানা অবরোধের ১৯ দিনে রাজধানীসহ সারা দেশে গুম হয়েছেন ১৬ জন। এর মধ্যে গুম হওয়ার কিছুদিন পর লাশ পাওয়া গেছে ৬ জনের। বাকিরা এখনও রয়েছেন নিখোঁজ। পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে তাদের তুলে নেয়া হলেও স্বীকার করছেন না প্রশাসনের কেউ। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন-পূর্ব আন্দোলনে সারা দেশে বিরোধী জোটের ৬৫ নেতাকর্মী গুম হয়েছিলেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই গুম হয়েছিলেন ২২ জন।
এদিকে ২০শে জানুয়ারি ঢাকায় ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান জনি। তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মনিষা জানান, মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে জনি জানিয়েছিলেন, খিলগাঁও থানার বিএনপি-ছাত্রদলের চার-পাঁচজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হবে। এ রকম একটি তালিকা তৈরি করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তালিকাভুক্তদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি করে হত্যা করবে ডিবি। গত ১৯শে জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলে ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন নড়াইলের জামায়াত নেতা ও পৌর কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট ইমরুল কায়েস (৪০)। ১৬ই জানুয়ারি রাতে ওয়ারী থানার ৬১, দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে কায়েসের শ্যালক অ্যাডভোকেট সোহেলের বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক তাকে আটক করে। পরদিন পরিবারের পক্ষ থেকে থানা, ডিবি ও র‌্যাব অফিসে যোগাযোগ করা হলে সবাই আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। এর একদিন পর ১৯শে জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তার লাশ পাওয়া যায়। এদিকে জামায়াত এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইমরুল কায়েসকে হত্যা করেছে। ১৬ই জানুয়ারি পুলিশের নির্যাতনে নিহত হন মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা মোহন বেপারি (৫৮)। তার শ্যালক আল-আমিন অভিযোগ করেন, গত ১১ই জানুয়ারি মোহন বেপারিকে চিড়িয়াখানা গেট এলাকা থেকে আটক করে শাহ আলী থানা পুলিশ। এরপর থানায় অমানবিক নির্যাতনের পর তাকে আদালতে পাঠানো হয়। ১৪ই জানুয়ারি অসুস্থ মোহন বেপারিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ই জানুয়ারি তিনি মারা যান। এদিকে ১২ই জানুয়ারি রাতে জামায়াতের কাফরুল থানার একটি ওয়ার্ডের সভাপতি একেএম তৌফিকুল হককে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয়। এরপর থেকে তৌফিকুলের কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। জামায়াতের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে সরকারি নীলনকশার অংশ হিসেবে তৌফিকুলকে আটকের পর গুম করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক দপ্তর নেতা টুটুল অভিযোগ করেন, গত ১৮ই জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে রাজধানীর খিলগাঁও থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি জাহিদুর রহমান দিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।
এদিকে ১৬ই জানুয়ারি র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি মতিউর রহমান। জানা গেছে, গত ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কল্যাণপুর স্কুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মতিউর রহমান, মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. আবু তাহের শিশির, শ্যামল কুমারসহ ৫ জনকে। এর মধ্যে মতিউর রহমানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. শিশির এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। বাকি দু’জনকে থানায় হস্তান্তর করে পুলিশ। এ ব্যাপারে শিশিরের পিতা মুজিবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ১৫ই জানুয়ারি বিকাল ৩টায় আমার বাড়ির সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক আমার ছেলেসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে মতিউর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। তবে আমার ছেলের সন্ধানের জন্য থানা ও র‌্যাবের কাছে গিয়েছি। তারা স্বীকার করেনি। এখনও আমার ছেলের খোঁজ পাইনি। শিবগঞ্জ থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। তিনি বলেন, আমার ছেলে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে স্থানীয় বাজারে ডেউটিনের ব্যবসা করতো। আমার স্ত্রী ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। এছাড়া ৫ই জানুয়ারি চাঁপাই নবাবগঞ্জে যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হন মো. জামশেদ নামের এক বিএনপিকর্মী।
এদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, গত ১৫ই জানুয়ারি রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলায় অভিযান চালিয়ে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর নেতা আল-আমীন ও তার স্ত্রী বিউটি বেগম এবং তাদের প্রতিবেশী মৌসুমীকে তুলে নিয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আল-আমীনকে থানায় নিয়ে তাকে গুলি করে আহত করেছে এবং তার হাত ভেঙে দিয়েছে। তাদের তুলে নেয়ার ৮ দিন পর কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরও এ ব্যাপারে তারা কোন কিছু জানাতে অস্বীকার করছে। ওদিকে ৫ই জানুয়ারি পুলিশ পরিচয়ে হাফিজুর রহমান (৪০) ও সাগর আলী (২৫) নামে দু’জনকে আটক করে কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা পুলিশ। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সাগরের ফুফাতো ভাই রবিউল ইসলাম ৭ই জানুয়ারি মিরপুর থানায় একটি জিডি করেছেন। ১৭ই জানুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার বাটপাড়া গ্রাম থেকে কৃষক নাসির উদ্দিনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে ১৯শে জানুয়ারি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় স্থানীয় মোহনপুর বিল এলাকায় রাস্তার পাশে একটি মাঠে নাসিরের লাশ পাওয়া যায়। তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছে, পোশাকধারী পুলিশ ও র‌্যাব নাসিরকে আটক করলেও পরে যোগাযোগ করলে তারা অস্বীকার করেছে।
৯ই জানুয়ারি কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রদল নেতা জসিমউদ্দিন, সুজন চন্দ্র দাস, রোমান আহমেদ, কেএম নজরুল হাসান ও ইরফান আহমেদ ওরফে ফাহিমকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয়। পরে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে পুরান ঢাকা থেকে সংগঠনটির পাঁচ নেতাকে আটক করলেও পুলিশ স্বীকার করছে না। এরপর ১৩ই জানুয়ারি তাদের মিরপুর থানায় একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, যেভাবে সারা দেশে গুম-খুন, ক্রসফায়ার ও বিভিন্ন জেলায় যৌথবাহিনীর তাণ্ডব চলছে সেটা খুবই উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানবতা বিপন্ন হবে।

No comments

Powered by Blogger.