বিস্মিত হয়েছিল কূটনৈতিক দুনিয়া

৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে শেষ মুহূর্তেও  চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন কূটনীতিকরা। দেশে ‘স্থিতিশীলতা’ ফিরিয়ে আনা ও সব দলের অংশগ্রহণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়াসে বিদেশী দূত, আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখার পাশাপাশি পর্দার আড়ালে ‘সংলাপ-সমঝোতার চেষ্টা’ও করছিলেন। দূতিয়ালির মাঝপথেই নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করে। সিইসি’র ওই ঘোষণায় উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। একই সঙ্গে অনিরাপদও হয়ে যায় সাধারণের চলাফেরা। রাজপথে সংঘাত-সংঘর্ষ, বিরোধী নেতাদের গণগ্রেপ্তার শুরু হয়। বিদেশী নাগরিকদের বাংলাদেশ অবস্থান এবং চলাচলে নিজ নিজ দেশ ও সংস্থার তরফে কড়া সতর্কতা জারি করা হয়। সমঝোতার আলোচনার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওই ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে জাতিসংঘসহ দূতিয়ালির সঙ্গে যুক্ত বিদেশী বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগীরা। নির্বাচন এক তরফা হলে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে ইইউ। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিরোধীরা আন্দোলন সফলে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের ঠেকাতে সরকারও কড়া অ্যাকশনে যায়। এ অবস্থায় বিশ্ব সমপ্রদায় সরকার ও বিরোদী দলকে সংযত থাকার অব্যাহত অনুরোধ জানায়। কিন্তু কে শুনে তার কথা। সহিংসতা চলতে থাকে। বাড়তে থাকে সরকারের দমন পীড়নও। ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকা সফরে আসেন জাতিসংঘ ও ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিনিধি। কাছাকাছি সময়ে তারা ঢাকায় আসেন। প্রতিবেশী ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ‘শুভেচ্ছা সফরে’ এলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে তার সরকারের অবস্থান জানান তিনি। বিশ্ব সমপ্রদায় যখন ‘সব দলের অংশগ্রহণের পক্ষে’ জোরালো বক্তব্য দিচ্ছিল, তখন ভারতের ওই প্রতিনিধি বলেন, তার দেশ বাংলাদেশে অধিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন দেখতে চায়। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে যাওয়ার আহ্বানও জানান ওই কূটনীতিক। সুজাতার বিদায়ের পরপরই ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অসকার ফার্নান্দেজ তারানকো। সংস্থার রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সচিব তারানকো মহাসচিবের পক্ষে দূতিয়ালি মিশন নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকায় পৌঁছানোর আগে তিনি সরকার ও বিরোধী সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সিডিউল পেছানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেন তারা। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধিকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন তারানকো। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে নির্বাচনী শিডিউল পেছানোর ইতিবাচক ইঙ্গিতও পান। পাঁচ দিনের দূতিয়ালি মিশনে ১৯টি বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের এক টেবিলে বসাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন তিনি। তার উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা অন্তত চারটি পয়েন্টে একমত হন। এগুলো হচ্ছে- ১. বিরোধী নেতাকর্মীদের মুক্তি, ২. মামলা প্রত্যাহার, ৩. বিরোধী দলগুলোর অফিসগুলো খুলে দেয়া, ৪. সভা-সমাবেশের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার। ১০ই ডিসেম্বর প্রথম দফা এবং ১১ই ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা বৈঠকে তারানকো এই চারটি পয়েন্টে ঐকমত্য দেখে খানিকটা উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১১ই ডিসেম্বর যখন বৈঠক প্রায় সমাপ্তির দিকে তখন আওয়ামী লীগের তরফে বলা হয় এই পয়েন্টগুলোর ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনই নেয়া যাবে না। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুহূর্তেই তারানকোর মুখ অনেকটা মলিন হয়ে যায়। ‘ওয়েল, আপনারা আবার বসে আলোচনা করুন’ বলেই বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও হতাশায় ভেঙে পড়েন। কারণ তার চেষ্টাতেই প্রাথমিক সাফল্য এসেছিল। মূল দুটো পয়েন্ট, যথা- নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন ও নির্বাচনকালীন সরকারে কে থাকবেন তা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগেই এভাবে সংলাপের ভাগ্য ঝুলে যায়। তারানকোর বিদায়ের পর ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির উপস্থিতি আরেক দফা বৈঠক হয়। কিন্তু কোন সাফল্য আসেনি। দুই দলের একাধিক সূত্রে জানা যায়, সরকার সামান্যতম ছাড় দিতে রাজি হয়নি। তারা পূর্বশর্ত দেন হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করলেই শুধু এসব দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে। এজন্য লিখিতও দিতে হবে। বিরোধী বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত দিতে সম্মত হয়নি। সংলাপের পরিবেশ তৈরি হলে সবকিছুই করতে রাজী ছিল বিএনপি। হরতাল-অবরোধ স্থগিত রাখতে বিএনপি’র তরফে ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আলোচনা আর এগোয়নি। জাতিসংঘের দূতিয়ালি মিশন এখানেই থেমে যায়। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯৪ সালে। স্যার নিনিয়ান স্টিফেন সে সময় সমঝোতার মিশন নিয়ে এসেছিলেন। নিনিয়ানের দেড় যুগ পর এসেছিলেন তারানকো। কিন্তু ফল একই, তিনি সফল হতে পারেননি। বিদায় বেলা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের আরও ‘নমনীয়’ হওয়ার অনুরোধ জানান ওই কূটনীতিক। জাতিসংঘের উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দেন বিদেশী কূটনীতিকরা। রাজপথে লাশের সারি দীর্ঘ হতে থাকে। সংঘাতময় ওই পরিস্থিতিতে বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বর্জন করেন ঢাকাস্থ ইইউ জোটের রাষ্ট্রদূতরা। নজিরবিহীন ওই ঘটনায় কূটনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের নির্বাচন প্রস্তুতি সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে ‘সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচন’ দেয়ার ঘোষণা দেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্ব সমপ্রদায়কে জানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জরুরি কূটনৈতিক ব্রিফিং আহ্বান করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টাও যোগ দেন। আগে থেকেই ঢাকায় কর্মস্থল, বাসভবন ও চলাফেরায় বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন বিদেশী কূটনৈতিকরা। ওই ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিভাবে এটি সরকারের প্রতিনিধিদের নজরে আনা হয়। সরকারের তরফে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়। ওই ব্রিফিংয়ের দুদিন পর কূটনৈতিক জোন গুলশানের খালেদা জিয়ার বাসভবনের প্রবেশ সড়কের দুই ধরে বালিভর্তি ট্রাক দিয়ে আটকে দেয়া হয়। তার বাসায় প্রবেশকারীদের চলাচলে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হয়। একপর্যায়ে তিনি কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। ওই সময়ে নেতারা খালেদার দেখা না পেলেও ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাকে আটক করা হয়। খালেদা জিয়ার বাড়ির সমানে বালির ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা এবং দলের নেতাদের গ্রেপ্তারে কূটনৈতিক পল্লীতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। এ অবস্থায় নির্ধারিত তারিখেই সরকার এক তরফাভাবে নির্বাচনটি সম্পন্ন করে। ৬ দিনের মধ্যে নতুন সরকারও গঠিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.