সেদিন যা ঘটেছিল

৫ই জানুয়ারি ২০১৪। ‘বিতর্কিত’ এক নির্বাচন সারা বিশ্বের চোখ ফিরিয়ে ছিল বাংলাদেশের দিকে। এ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে সংঘটিত হয় নজিরবিহীন সহিংসতা। নির্বাচনের আগের দিনই জেলায় জেলায় ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয় সহিংসতা। নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধী দল হরতালসহ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আগেই। এই কর্মসূচি আর ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে ভোটের দিন ও আগের দুই দিনে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়। হামলায় মারা যান নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা। ভোটের আগের দিন রাতেই ৪৩ জেলার দু’শতাধিক ভোটকেন্দ্রে  অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জোবায়দুল হককে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া মৌলভীবাজার, যশোরের মনিরামপুরে আরও দুই সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে কুপিয়ে আহত করা হয়। তাছাড়া কয়েকটি কেন্দ্র থেকে হাতবোমা উদ্ধার করে পুলিশ। অব্যাহত অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায়। রংপুরের পীরগাছা ও লালমনিরহাটে দুই প্রিজাইডিং অফিসার ও চট্টগ্রাম, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লক্ষ্মীপুরে দুটি করে এবং দিনাজপুর ও নীলফামারীতে একটি করে কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। তফসিল ঘোষণার পর ১৫৩টি আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের শরিক দলের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এটিও ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় সহিংসতা। ১৪৭টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রগুলো সকাল থেকেই ছিল ফাঁকা। কয়েকটি আসনের ৪১টি কেন্দ্রে কোন ভোটই পড়েনি সারা দিনে। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং সরকার দলের সঙ্গে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে একজন আনসার সদস্য,  একজন আওয়ামী লীগ কর্মী ও একজন পথচারী ছিলেন। বাকিরা বিএনপি ও জামায়াত কর্মী। সংঘাত ও সহিংসতার কারণে সারা দেশে পাঁচ শতাধিক ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এর মধ্যে রংপুরে ৮৪, গাইবান্ধায় ১২৯, নীলফামারীতে ৯টি, দিনাজপুরে ৪৫ এবং বগুড়ায় প্রায় ১০০টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এদিকে ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রগুলো ভোটারশূন্য থাকলেও নির্বাচন কমিশনের ভোটের ফলে গড়ে ৪০ ভাগ ভোট পড়ে বলে দেখানো হয়। আর আসনভিত্তিক ফল ঘোষণা হলেও নির্বাচন কমিশন ভোটের হার ঘোষণা করে কয়েক দিন পর।  এদিকে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল ও সারা দেশের ১৮ দলের নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে অবরোধের পাশাপাশি টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের  ঘোষণা দেন বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুক। এছাড়া একতরফা ওই নির্বাচন দেশবাসী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে মন্তব্য করে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে একতরফা ওই নির্বাচনে  ৪-৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেন সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী। ৬ই জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আলবার্ট কোনৎসে। এরপর রাত ৮টায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ব্যুরো চিফ ও পলিটিক্যাল এডিটর অ্যালেন বেরি বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে বিকালে ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা চলাকালে হরতাল-অবরোধ বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানিয়ে স্মারকলিপি দিতে খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়েছিলেন পাঁচ শিক্ষার্থীর অভিভাবক। এদিকে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২৫শে নভেম্বর একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১৮২ জন। আহত হন পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। ওদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক বিবৃতিতে জানায়, ২৫শে নভেম্বর থেকে ৩রা জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় ১৪৯ জন নিহত এবং ৪৮৮৬ জন আহত হন। এসময় ৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলেও তথ্য প্রকাশ হয়।

No comments

Powered by Blogger.