পিনাক-৬ নৌদুর্ঘটনার দায়ীরা বহাল তবিয়তে

মর্মান্তিক পিনাক-৬ নৌদুর্ঘটনায় দায়ী কর্তাব্যক্তিরা নিজ নিজ দপ্তরে বহাল তবিয়তে আছেন। শুধু বহাল তবিয়তেই নয়, এদের মধ্যে একজনের ইতিমধ্যে পদোন্নতিও হয়েছে। পিনাক দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্টে চালক (সুকানি) গোলাম নবী বিশ্বাস, লঞ্চের তত্ত্বাবধায়ক ও মালিকের পুত্র ওমর ফারুক লিমন, মালিক আবু বকর সিদ্দিক কালু, মাওয়া নদীবন্দরের পরিবহন পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, বিআইডব্লিটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিট্রা) শফিকুল হক ও যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমান, নৌ-স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইদুর রহমান, তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম, বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক (নৌ নিট্রা) সাইফুল হক খান, ভূতপূর্ব নৌযানের মালিক মনিরুজ্জামান খোকনকে দায়ী করা হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে পদোন্নতি দিয়েছে। তিনি এখন পরিচালক সমপর্যায়ের মাদারীপুরের চরমুগরিয়াতে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শিপ পার্সোনেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে পিনাক দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টের দুই দিন পর ১৩ই আগস্ট ২০১৪ নিয়োগ দেয়া হয়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল সদরঘাট নদীবন্দরের সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমান ও মাওয়া নদীবন্দরের পরিবহন পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে বরখাস্ত করা হয়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার, এরই মধ্যে নিজ পদে পুনর্বহাল হয়েছেন মীর্জা সাইফুর রহমান। সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যে একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম জাকিউর রহমান ভূঁইয়া ২৫শে নভেম্বর থেকে ছুটিতে ছিলেন। এ সুবাদে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সার্ভেয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম। মহাপরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার রুটিন দায়িত্ব (নীতিনির্ধারণী বিষয় এবং বদলি ছাড়া) পালনের কথা। তবে যোগ দেয়ার প্রথম দিনই অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর ফখরুল ইসলাম মন্ত্রণালয় থেকে পিনাক লঞ্চডুবির ঘটনায় অভিযুক্ত শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুরের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করেন এবং তাকে পদায়নের জন্য চিঠি পাঠান আর ওই দিনই তা কার্যকর হয়। সে আলোকে মীর্জা সাইফুর ওই দিনই কর্মস্থলে যোগ দেন। বিভাগীয় মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলমান থাকার পরও একই দিনে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার ও কাজে যোগ দেয়ার নজির বিরল। এ ব্যাপারে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমি মন্ত্রণালয়ের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মীর্জা সাইফুরের সাসপেনশন প্রত্যাহার করেছি। ‘মহাপরিচালক অনুপস্থিতিতি সাসপেনশন প্রত্যাহার করার অধিকার রাখেন কিনা’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তখন মহাপরিচালক ছিলাম। অতএব আমি মহাপরিচালক হিসেবে এ কাজ করার অধিকার রাখি। তবে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম জাকিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, জানানো হলে ভাল হতো। কিন্তু মীর্জা সাইফুরের সাসপেনশন প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনি আমাকে জানান নি। তিনি আরও বলেন, সাসপেনশন প্রত্যাহার মানেই তো আর দায় থেকে মুক্তি পাওয়া নয়। সার্ভেয়ার কম থাকায় মন্ত্রণালয় তাকে পুনর্বহাল করেছেন। সূত্র জানায়, অপর দায়ী কর্মকর্তা মাওয়া নদীবন্দর পরিবহন পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সাসপেনশন প্রত্যাহার সময়ের ব্যাপার মাত্র। রীতিমতো তিনি বিআইডব্লিটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে অফিস করছেন। এসব ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন নাগরিক সমাজ ও দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের স্বজনরা। শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পিনাক-৬ দুর্ঘটনার চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। এ ব্যাপারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান মানবজমিনকে বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সার্ভেয়ার সঙ্কট থাকায় কেবল মির্জা সাইফুরের সাসপেনশন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে এখনও বিচার বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। পদোন্নতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দায়ী কোন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে তা আমার জানা নেই, তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারছি না। আর এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের সচিব মো. আবদুল আউয়াল মানবজমিনকে বলেন, তদন্ত কমিটি যাদের দায়ী করেছে আমার জানামতে তাদের প্রত্যেক কর্মকর্তার কাছে জবাব জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের জবাবে সন্তুষ্ট না হলে বিধি অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত ৪ঠা আগস্ট মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় পিনাক-৬ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে শতাধিক যাত্রী মৃত্যুবরণ করেন। তবে সরকারি তথ্য মতে, ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ জন নিহত ও ৬০ জন নিখোঁজ হন। পরে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ১০ই আগস্ট উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নৌপররিবহন মন্ত্রণালয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন জসীম উদ্দিন সরকারকে সদস্য সচিব এবং বাকিদের সদস্য করা হয়। সদস্যরা হলেন স্পেশাল মেরিন সেফটি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (রাজস্ব) মো. নজরুল ইসলাম সরকার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. গৌতম কুমার সাহা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রহিম তালুকদার এবং নৌ-দুর্ঘটনা স্থায়ী তদন্ত কমিটির সদস্য ফিরোজ আহমেদ। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয় বৈরী আবহাওয়া ও তীব্র স্রোত, চালকের বেপরোয়া লঞ্চ পরিচালনা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনকে দায়ী করেছেন। আর প্রাসঙ্গিক কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে মালিকের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের মাসসিকতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা, রুট পারমিট ও টাইম শিডিউল প্রদানে অনিয়ম, ডিজাইন ত্রুটিকে দায়ী করা হয়েছে।
তদন্ত রিপোর্টে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে এবং ১ নম্বর সতর্ক বার্তা, নদীতে প্রচণ্ড স্‌্েরাত ও ঢেউ সত্ত্বেও ঘূর্ণি আবর্তের ওপর মাঝ নদী দিয়ে আড়াআড়িভাবে বেপরোয়া নৌযান পরিচালনা করায় চালক (সুকানি) গোলাম নবী বিশ্বাস, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর জন্য লঞ্চের তত্ত্বাবধায়ক মালিক পুত্র ওমর ফারুক লিমন এবং মালিক আবু বকর সিদ্দিক কালুকে দায়ী করা হয়। মাওয়া-কাওড়াকান্দি ঘাটে দায়িত্ব পালন না করায় মাওয়া নদীবন্দরের পরিবহন পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে, ঈদ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মাওয়া-কাওড়াকান্দি-কাঁঠালবাড়ী ঘাটে যাত্রী সমাগম বেশি হবে জেনেও ওই স্থানে সাময়িকভাবে অতিরিক্ত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর নিয়োগ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে দায়িত্ব অবহেলায় কারণে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিট্রা) শফিকুল হক ও মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে দায়ী করা হয়। ২৮শে এপ্রিল ২০১৪ বার্ষিক সার্ভেতে ৬টি ত্রুটি চিহ্নিত করার পরও মীর্জা সাইফুর রহমান ওই নৌযানটি ৪৫ দিন চলাচলের টোকেন দেন। এরপর আইনে ৪৫ দিনের অধিক সাময়িক চলাচলের অনুমতি দেয়ার বিধান না থাকলেও আরও দুই দফায় ৩০ ও ৪৫ দিন সময় বর্ধিত করেন। নৌযানটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সন্তোষজনক প্রতিবেদন দেয়ায় নৌ-স্থপতি ও সরকারি তালিকাভুক্ত প্যানেল সুপারভাইজার ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইদুর রহমানকেও দায়ী করা হয়। বরিশালের তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম যাচাই-বাছাই না করে নৌযানটি অনুমোদনবিহীন অবস্থায় চলাচল এবং পরে স্থায়ী রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দায়িত্ব অবহেলা করে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ৭২ ধারা লঙ্ঘন করায় তাকে দায়ী করা হয়।
এ ব্যাপারে জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক মানবজমিনকে বলেন, পিনাক দুর্ঘটনায় এতগুলো মানুষ মৃত্যুবরণ করলো, এমনকি উদ্ধারও হলো না দুর্ঘটনা পতিত জাহাজটি, যার বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলমান- ঠিক এ মুহূর্তে সার্ভেয়ার মির্জা সাইফুরের সাসপেনশন প্রত্যাহার মোটেও সমুচিত হয়নি। এতে সরকারি কর্মকর্তারা আইনবহির্ভূত কাজ করতে আরও উৎসাহিত করবে। সেই সঙ্গে পিনাক বিচারব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও থমকে দেবে। পিনাকের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি মাওয়া ও সদরঘাটে গণশুনানির দাবি করেন। এ ব্যাপারে কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক মো. মজিবুল হক মনির মানবজমিনকে বলেন, মির্জা সাইফুল ইসলামের সাসপেনশন প্রত্যাহার একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এ ঘটনাটি এমন সময় ঘটেছে যখন ডিজি দেশের বাইরে ছিল। তিনি আরও বলেন, পিনাক দুর্ঘটনার পর দায়ী মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের পদোন্নতি কোনভাবেই সমুচিত হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.