এক বছরেও বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটেনি: সিপিডি

৫ই জানুয়ারির নির্বাচন অন্তর্ভুক্তি ও সমঝোতামূলক ছিল না বলে গত এক বছরেও বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটেনি বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নতুন বছরের শুরুতে ফের অস্থির হয়ে উঠছে রাজনীতি, নাশকতা ও সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেও মনে করে সংস্থাটি। সিপিডি’র সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক সমঝোতা, সহাবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। এসব কারণে বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে মূল চ্যালেঞ্জ বেসরকারি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হওয়া উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, মৌলিক ৩টি কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এগুলো হলো অবকাঠামো সমস্যা, মুদ্রা ও পুঁজিবাজারে সংস্কারের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি আয়োজিত দেশের অর্থনীতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিডি’র সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। সিপিডি’র মতে, একদিকে বিনিয়োগ কমছে, অন্যদিকে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। বর্তমানে যে হারে টাকা বিদেশে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশে দেয়া বিদেশী অনুদানের চেয়ে বেশি। আবার যে টাকা পাচার হচ্ছে, তার কিছু অংশ বিদেশী ঋণ আকারে তা দেশে আসছে। এ অবস্থায় যেসব পণ্য আমদানি হচ্ছে, তা কোন খাতে যাচ্ছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-১৫ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া বিফ্রিংয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেক দিন ধরে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই এটাকে ‘বাংলা প্রবৃদ্ধি’ বলা যায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটের অভাব, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এটি বাড়ানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সাধারণত নির্বাচনের পর বিনিয়োগ, ঋণপ্রবাহসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি ঘটেনি। নির্বাচন হলেও অনিয়শ্চয়তা কাটেনি বরং সহাবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। নতুন করে নাশকতা ও সহিংসতার আশঙ্কাও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের এক বছরের পরও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি আসেনি। এক তরফা নির্বাচনের কারণে এটি হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নির্বাচনের কারণে কিনা জানি না, তবে নির্বাচনের পর তা আর বাড়েনি। বাকিটা বোঝার দায়িত্ব আপনাদের। সিপিডি’র এ গবেষক আরও বলেন, সমপ্রতি আমদানি ও শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। আমদানিতে ওভারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। কেননা যে পরিমাণ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি দেশে শিল্প স্থাপনের প্রকৃত চিত্র সেটি নির্দেশ করে না। এক গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ভারত ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স অর্জন করে বাংলাদেশ থেকে। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বাড়ছে, কিন্তু তার অধিকাংশই এলটিআর, যা পরিশোধ না করতে পেরে মেয়াদি ঋণে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ ও পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা যায়। উভয় খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংকিং খাতে কোন সংস্কার হয়নি। সে কারণে একের পর এক দুর্নীতির স্ক্যান্ডাল বের হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ৫৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আজকের খেলাপির জন্য দায়ী বারবার রিশিডিউল করা। এ দেশে বেনামি ঋণও রিশিডিউল হয়; বড় আজব। পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না। মূল প্রবন্ধে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি, আমদানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়, এডিপি বাস্তবায়ন, বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বেড়েছে খেলাপি ঋণেরর পরিমাণও। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। নির্বাচনের পর আশা করা হয়েছিল ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। তা হয়নি। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে করতে হলে অবশ্যই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ও পুঁজিবাজার প্রয়োজন। ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন ও পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করা হয়। এই দুই খাতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ব্যাংক খাত নিয়ে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে কুঋণ বেড়েছে। আবার খেলাপি ঋণকে বারবার নিয়মিত করা হচ্ছে। এটি ব্যাংকের মুনাফা ও মূলধন কমছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে বারবার মূলধন সহায়তা দেয়াকে লাভের বিরাষ্ট্রীকরণ ও ক্ষতির রাষ্ট্রীকরণ করা হচ্ছে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় করতে বাকি সময়ে রাজস্ব আয় ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে। এ পরিস্থিতিতে বছর শেষে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো মোট রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। বিনিয়োগ না হওয়ার বিষয়ে সিপিডি’র অতিরিক্ত গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিনিয়োগকারীদের কাছে অর্থ আছে। কিন্তু বিনিয়োগের সহায়ক উপকরণের সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের পর যে ধরনের বিনিয়োগের প্রত্যাশা থাকে, তা গত এক বছরেও পূরণ হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.