কথা নিষিদ্ধ করা যায়, চিন্তা যায় না by মাহবুব কামাল

প্রথমে আমরা র‌্যান্ডম ভিত্তিতে দুটি স্যাম্পল বেছে নেব। দুটি উপজেলা। ধরা যাক, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও দূরবর্তী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। এবার এ দুই উপজেলার ছাত্রলীগ সভাপতিদ্বয়কে আলাদা জায়গায় বসিয়ে রাজনীতি বিষয়ে দশটি একইরকম প্রশ্ন করবো আমরা। দেখা যাবে, এদের উত্তরে কোনো পার্থক্য নেই, বলার ভঙ্গিতেও। দুজনই জননেত্রী, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজাকার ইত্যাদির বাইরে খুব একটা যেতে পারছে না। আরও লক্ষ্য করা যাবে, দুজনের কণ্ঠেই কেমন যেন একটা ঝাঁঝ, বাচ্চা সামন্তপ্রভু যেন।
দলীয় রাজনীতি কি মানুষকে টাইপড করে ফেলে? নিজস্বতা কেড়ে নেয়? কিবরিয়া সাহেবের কথা মনে পড়ে। গ্লোবাল পার্সোনালিটি তো বটেই, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পর্যন্ত হয়েছিলেন। সমগ্র জীবনটাই ছিল তার নিজস্বতায় ভরা। সেই তিনি আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর নিজস্ব থেকে পরস্ব হয়ে গেলেন। হুমায়ুন আজাদ ছুরিকাহত হওয়ার পর সিএমএইচে থাকাকালীন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নিয়মিত বৈঠকের একটিতে তিনি বললেন, হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন, খবরটা চেপে রেখেছে সরকার। বুঝবো না কেন, তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারকে কনডেম করাই ছিল এ মন্তব্যের উদ্দেশ্য। টেবিলের ওপাশে থাকলে অযৌক্তিক কথাও উচ্চকণ্ঠে বলা যায়, এপারে বসে যৌক্তিক কথাও বলা যায় না, বলতে চাইলে নিমস্বরে বলতে হয়। আমিও তেমন অনুচ্চ স্বরেই বলি, ছুরিকাহত হওয়ার পর টেলিভিশনে তার যে চেহারা দেখেছি, তাতে রক্তাক্ত হলেও মনে হচ্ছিল না যে, তিনি মারা যাবেন। ক্ষেপে গিয়েছিলেন কিবরিয়া সাহেব। পরে দেখা গেল, হুমায়ুন আজাদ মরেননি। এখানেই শেষ নয়। তিনি যখন জার্মানিতে মারা গেলেন, কিবরিয়া সাহেব বললেন, এটা ষড়যন্ত্রমূলক হত্যা! আকাশ খুব দূর হয়ে যাবে, সিয়ার্স টাওয়ার থেকে পড়লাম আমি। কারণ, আজাদের মৃত্যুর পরপরই ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের মুরশেদ ও জার্মানি প্রবাসী লেখিকা সুলতানা আজিমের কাছ থেকে আমি সবই শুনেছিলাম। অনেক প্রবাদের মতো মৌনতা সম্মতির লক্ষণও নির্ভুল পর্যবেক্ষণজাত নয়। আমি চুপ মেরে গেছি। রাতে খাবার টেবিলে বাসার সবাইকে কিবরিয়া সাহেবের conspiracy theoryর কথা বলতেই ক্লাস টেনে পড়া আমার ছেলে শুধু বলেছিল- আব্বু জার্মান পুলিশ কি মিথ্যা বলবে (নিজের ছেলের প্রসঙ্গ আনায় দুঃখিত, কী করবো, অন্য কেউ তো এমনটা বলেনি)?
ছাত্রলীগে ফিরে আসি। হ্যাঁ, এটি একটি টাইপড শ্রেণী। ব্যতিক্রম থাকলে সেটা ওয়ান ইন অ্যা মিলিয়ন, এক হাজার তরুণ-যুবকের মধ্যে পাঁচটা ছাত্রলীগার থাকলে উদ্ধত চেহারা দেখে তাদের আলাদা করা সম্ভব। টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে টিএনও, উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার বা এ ধরনের কর্মকর্তাদের ধমকাতে ধমকাতে তাদের চেহারা জমকালোই নয় শুধু, ধমকালোও বটে। এরা লেখাপড়া কখন করে, জানতে ইচ্ছে করে খুব। আমার স্ত্রীর (সে নিশ্চয়ই এ লেখাটা পড়বে) বড় ভাইয়ের ছেলে স্কুলে থাকতেই ছাত্রলীগ করত। পাঁচ মানে চার বা ছয় নয়, হ্যাঁ সে এসএসসিতে পাঁচবারই ফেল করে ছাত্রলীগ বাদ দিয়ে যুবলীগে ঢুকলো। এখন সে যুবলীগ, পাটগ্রাম উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। টাকাটা কীভাবে এলো, পাঠককেই ভেবে বের করতে হবে, সে এখন কোটিপতি। কে বেশি জাগতিক- আপনার, আমার ছেলে, নাকি সে? এদেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্মার উন্নয়ন নয়, উপার্জন। আপনার, আমার ছেলে রিটায়ারমেন্টের পর বড়জোর ৪০-৫০ লাখ টাকা পাবে, আর সে? এখনই কোটিপতি, যুবলীগ থেকে যখন আওয়ামী লীগে রূপান্তর ঘটবে, তখন? সিংহ শাবকের চেয়ে পশুরাজ সিংহের ক্ষুধা ও ক্ষুধা নিবৃত্তির শিকার- দুটোই অনেক বেশি।
হ্যাঁ, ছাত্রলীগাররা পড়েটা কখন আর যদি পড়েই, তাদের রিডিং মেটেরিয়ালস কী? নতুন প্রজন্মের কারও সঙ্গে কথা বলার সময় আমি প্রায়ই মানবসভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত সেরা পাঁচ ব্যক্তির নাম করতে বলি তাকে। ছাত্রলীগাররা যাদের নাম করে, শুনলে সেই কথাটাই মনে পড়ে আমার- একজন মূর্খ স্ত্রী তোমাকে যে জ্ঞান দেবে, একশ পণ্ডিতও তা পারবে না। তারা তাদের দৃষ্টি উপমহাদেশের বাইরে ফেলতেই পারে না। পাঁচজনের একজন হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে তারা বেছে নেয় অবধারিতভাবেই, তাতে বিশেষ আপত্তি থাকে না; ভালোবাসা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে মানুষকে উৎসাহিত করে বৈকি। কিন্তু পাঠক হাসবেন না, তাদের কেউ একজন শরৎচন্দ্র, হুমায়ূন আহমেদের নাম করেছে! কেন হাসবেন, দেবদাস ও হিমু যে তার মনে গভীর রেখাপাত করেছে! ছাত্রলীগাররা গণতন্ত্রের কথা বলে, কম্পিউটার চালায়, বিদ্যুতের আলো ঝলমল শপিংমলে কেনাকাটা করে- অথচ জানার চেষ্টা করে না এগুলোর শুরুটা কবে, কোথায়, কে করেছিল। অন্যদিকে তাদেরই সমবয়সী একজন অরাজনৈতিক ছাত্র বলেছে- স্যার, মুশকিলে ফেলে দিলেন। পাঁচজনের তালিকায় বিজ্ঞান থেকে নিউটনকে রাখবো, না আইনস্টাইনকে অথবা ডারউইনকে- বুঝতে পারছি না। রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যেই বা কাকে রাখবো- আব্রাহাম লিংকন, চার্চিল অথবা নেলসন ম্যান্ডেলা? পণ্ডিতরাও ঝামেলায় ফেলেছেন- অ্যারিস্টটল, প্লেটো, না আধুনিক যুগের কার্ল মার্কসকে রাখবো? আমি একদিন এক ছাত্রলীগারকে একটা কথা বলে বিপদেই পড়েছিলাম। কেন যে তাকে বলতে গেলাম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে চাকা! মনে হলো, সে তক্ষুনি স্লোগান তুলবে- মূর্খদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এক সাথে।
ছাত্রলীগ সম্পর্কে কেন খামাখা এসব বলছি? তারা তো আপনার, আমার চেয়ে ভালোই আছে। আমি, আপনি বিপদে পড়লে কেউই এগিয়ে আসবে না। আর তাদের কেউ হলে একটা হুইসেল বাজতে বাকি শুধু। মোবাইল কলগুলো মাল্টিপ্লাইড হয়ে মুহূর্তেই জড়ো হয়ে যাবে শখানেক লাঠিয়াল, এদের কারও কারও পকেটে থাকবে পিস্তলও। এরা সতীর্থের জন্য জান দিয়ে দেবে, কখনও কখনও অবশ্য সতীর্থের জান কেড়েও নেয়। চৈনিক প্রবাদে আছে- রাগান্বিত অবস্থায় চিঠি লিখতে নেই। প্রবাদটির মর্মার্থ হলো, রাগ তো একসময় না একসময় নেমে যাবেই; কিন্তু রাগের চিঠিটি পোস্ট করা হয়ে গেলে সেটাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ছাত্রলীগের সদাউজ্জীবিত সন্তানরা সামান্য রাগলেই আপনাকে গুলি করবে কি-না, ভাবার সময় নষ্ট করবে না।
তাদের কেন এই উন্মত্ততা? একটা কারণ তো স্পষ্ট। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমেরিকায় যখন অ্যাংরি ইয়াংম্যান আন্দোলন চলছে, যার ঢেউ ইউরোপেও আছড়ে পড়েছিল- মনস্তত্ববিদরা খুঁজে বের করলেন, অধিকসংখ্যক মানুষ সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করলে তাদের মধ্যে mob psychology বা গণউন্মত্ততা দেখা দিতে পারে। এই ফাইন্ডিংসের পর সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ডরমেটরির আকার ছোট করে ফেলা হলো। এদেশের ছাত্রাবাসগুলোয় হাজার হাজার ছাত্র যাপন করছে সংঘবদ্ধ জীবন। হুইসেল বাজিয়ে তারা একজোটে চড়াও হচ্ছে টার্গেটের ওপর।
আরেকটি যে কারণ, তাতে তাদের কোনো দোষ নেই, দোষটা তাদের অগ্রবর্তী প্রজন্মসমূহের। আমরাই সমাজটাকে জ্ঞানভিত্তিক না করে ভোগসর্বস্ব করে তুলেছি। সুতরাং ত্যাগেই সুখ বলে যারা, লাথি মারো তাদের মুখে। আবার ভোগ করতে হলে গেইন করতে হবে। এই গেইন কীভাবে করা যায়? একটা কোটেবল কোট তো আছেই- নো রিস্ক, নো গেইন। এই ঝুঁকিপ্রবণতায় তারা কথায় কথায় কোমরে লাগাচ্ছে হাত, বের করে আনছে পিস্তল। এদের আর এসো নীপ বনে গান শুনিয়ে লাভ নেই, সত্যজিতের ছবির মর‌্যাল বুঝিয়ে ফল নেই, রবি শংকরের সেতার বাজিয়ে শান্ত করার উপায় নেই। ছাত্রলীগ এখন এক ধরনের স্পন্ডলোসিস রোগের নাম- হাড়ে যা ঘটার ঘটে গেছে, ওষুধে কোনো কাজ হবে না, তাদের ব্যায়াম করিয়ে যতটুকু ভালো রাখানো যায়।
অনেকেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন। তারা নিশ্চয়ই মনে করেন, প্রস্টিটিউশন তুলে দিলেই পরিবেশদূষণ রোধ করা যাবে। সেটা যে আরও ছড়িয়ে যাবে ভাই! আমরা দল নিষিদ্ধ করতে পারি, মানুষের চরিত্র পারি না; কথা নিষিদ্ধ করতে পারি, চিন্তা পারি না; জামায়াত নিষিদ্ধ করতে পারি, ইসলামী জোশ পারি না; হেফাজত নিষিদ্ধ করতে পারি, দাড়ি-টুপি পারি না। ঢাকাইয়া ফিল্মে নায়ক ভিলেইনকে মেরে চলেছে। সেখানে পুলিশ এসে হাজির। দূর থেকে নায়ককে উদ্দেশ করে পুলিশ অফিসার বলছেন- আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। নায়ক এবার ভিলেইনকে লাথি মারতে মারতে বলছে- কোথায় দেখলেন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছি, আইনতো তুলে নিয়েছি পায়ে! চিন্তা যেহেতু নিষিদ্ধ করতে পারি না আমরা, হাত নিষিদ্ধ করে লাভ নেই; হাতের কাজ তখন পা-ই করবে।
এই যে চাকচিক্যময় পরিপার্শ্ব, জৌলুস চারিধার- মাহাত্ম্য কী? সুরম্য অট্টালিকায় বাস করছেন, ছয় দরোজার মার্সিডিজ বেঞ্জে চড়েন, মাস শেষে হাজার হাজার কর্মচারীর বেতন দিয়ে গ্রেট এমপ্লয়ার হিসেবে তুষ্ট থাকেন- আপনি কি নিরাপদ? ষোলো-সতেরো বছরের এক হ্যাংলা-পাতলা তরুণ কিরিচের এক কোপ অথবা ট্রিগারের এক চাপে সাঙ্গ করে ফেলবে আপনার ভবলীলা। আমাদেরই সন্তান, অথচ কী হাল করে ছেড়েছি তাদের! প্রণোদিত না করে করছি প্ররোচিত। না, না এ অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।
আমি বেশ কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের এক জেলা শাখার সভাপতিকে বলেছিলাম- ছাত্রলীগ তো আপনাদের সাপ্লাই লাইন, এরাই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সাজাবে। তো এদের শিক্ষিত করে না তুলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- রাজনীতি করতে শিক্ষা লাগে নাকি? কমন সেন্স থাকলেই তো হয়! জেফারসন, চার্চিল অথবা নিদেনপক্ষে নেহরু বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম- কথাটা ঠিক কি-না। রাজনীতি মানে তো রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আর মেধা ছাড়া বিজ্ঞান হয়? ব্রিটিশরা সহস াব্দের সেরা ব্রিটিশ হিসেবে চার্চিলকেই নির্বাচন করেছে, নিউটন কিংবা ডারউইন অথবা শেক্সপিয়রকে নয়। ওই নেতা বলেন কী! একটি দেশ কী চরিত্র ধারণ করবে, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর ওপর আর তিনি কি-না বলছেন- রাজনীতি কমন সেন্সের ব্যাপার!
আমরা আসলে গর্তে পড়ে গেছি। কে তুলবে আমাদের এখান থেকে?
পুনশ্চঃ ছাত্রলীগ নিয়ে এ লেখার মাধ্যমে ছাত্রদল কর্মীদের হাতে পয়েন্ট তুলে দিলাম কি? ছেলেরা, তর্জনী উঁচিয়ে ছাত্রলীগকে দেখাচ্ছো ভালো, বুড়ো আঙুলটা দেখো তো কী অবস্থায় আছে! ওটা তোমাদের দিকেই তাক করা না?
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.