সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া ট্যাংকার নিয়ে রহস্য

গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে সুন্দরবনের দিকে, কি হচ্ছে সুন্দরবনে। বনের ভেতর তেলের ট্যাংকার ডুবির পর সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনও কাটছে না। কিন্তু যা নিয়ে এত হৈচৈ সেই তেলের ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এক সময় বালু ও পাথর টানার কাজে ব্যবহৃত হতো! এছাড়া অভিযোগ উঠেছে, ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটির তেল টানার মতো ফিটনেসও ছিল না। এছাড়া ট্যাংকারটিকে আসলেই কী ‘ওটি টোটাল’ ধাক্কা দিয়েছিল? তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। এদিকে পরিবেশবাদীদের কেউ কেউ এ ট্র্যাজেডির মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজছে। তবে সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসেন চৌধুরী এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকার একাধিক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ’ আসলে ছিল বালু ও পাথর টানার কার্গো। এটি নির্মিত হয় ১৯৯৮ সালে। এর মূল মালিক ছিলেন মানিকগঞ্জের আরিচা এলাকার শিল্পপতি আবদুর রহিম খান। তিনি ‘আল-মামুন’ নাম দিয়ে বুড়িগঙ্গা ও মেঘনাতে এটি পাথর টানার কাজে ব্যবহার করতেন। এর কিছু দিন পর তার মত পরিবর্তন করে কার্গোটিকে ‘ওটি আল-মামুন’ নাম দিয়ে ডিপো থেকে তেল ক্রয় করে বিভিন্ন নৌযানে সরবরাহ করতেন। ২০০৩ সালে ট্যাংকারটির নাজুক অবস্থা হলে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সেই সুযোগে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের  শ্যালক আমীর হোসেন ফরিদ সস্তায় ‘ওটি আল-মামুন’ ট্যাংকারটি ক্রয় করেন। পরে তিনি ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নাম দিয়ে খুলনা থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভোলা পাওয়ার প্লান্টে তেল টানার কাজে ব্যবহার শুরু করেন। সূত্র জানায় প্রতি পাঁচ বছর পর এসব নৌযান ডকিং করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের (ডস) বরিশাল কার্যালয়ের ‘ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার’ (প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক) মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার এটির অনুকূলে ফিটনেস সনদ প্রদান করে চলাচলের সুযোগ করে দেন। সূত্র জানায়, গত তিন বছর ধরে জাহাজটির বার্ষিক সার্ভে বা ফিটনেস দিয়ে আসছেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার। সর্বশেষ গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি এটির ফিটনেস দেয়া হয়।
অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ এর সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী, এ ধরনের জাহাজ প্রতি পাঁচ বছর পর ডকিংয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নৌপথের নিরাপত্তার স্বার্থে কারিগরি ত্রুটি  পরীক্ষা ছাড়া অবকাঠামোগত পরীক্ষা করানোর জন্য এই ডকিং প্রয়োজন। কিন্তু ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ গত ১১ বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালের পর আর ডকিং করানো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। সব কিছু জেনেও জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার এটির অনুকূলে ফিটনেস সনদ দেন। একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, টানা কয়েক বছর চলার পর এসব নৌযানে স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের কারিগরি ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এছাড়া অবকাঠামোগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে নৌযানের ধারণক্ষমতাও কমে যায়। এ কারণে প্রতি পাঁচ বছর পর ডকিং করানোর বিধান। ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজটি যদি ডকিং করানো হতো তাহলে হয়তো সামান্য ধাক্কায় এটি নদীতে ডুবতো না কিংবা এর ট্যাংকার (খোল) ফেটে তেল নির্গত হতো না। সে ক্ষেত্রে বিপর্যস্তও হতো না সুন্দরবন। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মো. কাশেম মাস্টার জানান, ট্যাংক রুট (বড় নৌ-রুট) দিয়ে তেলের ট্যাংকার চলতে হলে সার্ভে এবং রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট অবশ্যই প্রয়োজন। এছাড়া মাস্টার ড্রাইভার দক্ষ এবং দক্ষতার সনদ থাকতে হবে। তেল পরিবহনের জন্য বিস্ফোরক সার্টিফিকেট থাকতে হবে। রাডার, জিপিএস, ভিএইচএফ, আগুন নিভানোর জন্য পরিপূর্ণ সরঞ্জাম, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম, ট্যাংকারের বডি ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকতে হবে। যা প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই বড় রুট দিয়ে তেল টানার জন্য যে ধরনের ফিটনেস দরকার তা ছিল না ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ এর। এ ব্যাপারে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’এর সুপারভাইজার ওলিউল্লাহ বলেন, আমি কেনার পর থেকে গত তিন বছর ধরে ট্যাংকারটিতে আছি। আমাদের কাগজপত্র ফিটনেস সবই আছে। ‘ওটি টোটালই ধাক্কা দিয়ে ট্যাংকারটিকে ডুবিয়ে দিয়েছে। তবে ‘ওটি টোটালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ক্ষমতার দাপটে তাদেরকে ফাঁসানো হচ্ছে। এদিকে গত  সোমবার দুপুরে ‘ওটি টোটাল’ এর মাস্টারসহ ৪ জনকে আটক করেছে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানা পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে তাদেরকে মংলা থানায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থানায় কথা হয় নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ নেতা জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা বলছেন, আমরা কিছুই জানি না। শেলা নদীতে ওই সময় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ এর পাশে আমরাও নোঙর করেছিলাম। ডুবে যাওয়ার পর কয়েকজন নৌকায় করে এসে আমাদের নাম লিখে নিয়ে যান। আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সেভ দ্যা সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র হতে পারে মন্তব্য করে জোরালো তদন্ত দাবি করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে মংলা থানার ওসি বেলায়েত হোসেন জানান ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ এর পরিচালক গিয়াস উদ্দিনের দায়ের করা মামলায় (ধারা ২৮০/৪২৭/২৮০) তাদেরকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা দোষ স্বীকার করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। উল্লেখ, গত ৯ই ডিসেম্বর ভোর ৫টার  দিকে বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জয়মনি গোলের কাছে মংলাবন্দরের পশুর চ্যানেল সংলগ্ন শেলা নদীতে খুলনাগামী কার্গো জাহাজ এমটি টোটালের ধাক্কায় ডুবে যায় অয়েল ট্যাংকার (তেলবাহী জাহাজ) ওটি সাউদার্ন স্টার-৭। তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল (জ্বালানি তেল) বোঝাই নৌযানটির ট্যাংকার ফেটে বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (গরান বন) বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবন।

No comments

Powered by Blogger.