চট্টগ্রামে শতকোটি টাকার জায়গা বেদখল

চট্টগ্রামে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের (সাবীক) ১২০ কোটি টাকা মূল্যের ৪৫ কাঠা জায়গার ওপর তৈরি ৫ তলাবিশিষ্ট বিশাল আকৃতির চারটি ভবন দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। ওই চার ভবনে সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৭০ পরিবারের আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও এখন বসবাস করেন মাত্র ২৮ পরিবার। অন্যসব বাসা বহিরাগতদের দখলে। যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে তাদেরকেও বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সাল থেকে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বাসা বরাদ্দ বন্ধ রেখেছে। এদিকে চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সব জায়গা এখন বেদখলে। এমনকি এসব জায়গার পরিমাণ কত তাও জানে না কর্তৃপক্ষ। বীমা কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, কলোনিটির জন্য ২০১২ সালে ২৫ হাজার, ২০১৩ সালে ১০ হাজার ও ২০১৪ সালে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় কর্পোরেশন। এ টাকা দিয়ে কলোনি সংস্কার দূরের কথা একটি গ্রিলও সংস্কার করা হয়নি। ফলে কলোনিটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর কলোনিটির অগ্নিবীমার বিপরীতে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৭ টাকা দাবি অনুমোদিত হয়। ২০০৮ সালের ৩০ জুলাই এই টাকা সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের হিসাবে জমা হয়। কিন্তু সাবীক ভবনগুলো সংস্কারের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে কলোনিটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
কলোনিতে বসবাসকারী বাসিন্দারা জানান, বাসা বরাদ্দ বন্ধ রাখার একমাত্র কারণ হচ্ছে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বীমা কর্পোরেশনের জায়গাটি পানির দামে বিক্রি করে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। আর না হয় বাসা বরাদ্দ বন্ধ রাখবে কেন? এর ফলে কলোনিতে বসবাসরত কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতংকে দিন কাটাচ্ছে।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, কলোনিতে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। বাউন্ডারি দেয়ালগুলোর অবস্থা আরও করুণ। যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে এমন। কলোনিটির ভেতরে উত্তরপাশের এলাকা এখন সন্ত্রাসী মাস্তানদের আড্ডাস্থল। এখানে প্রতিদিন বসে গাঁজা, মদ ও হেরোইনসেবীদের আড্ডা। ভবনগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারে ছোঁয়া লাগেনি। এক ভবন থেকে অপর ভবনে যাওয়ার পথগুলোও আগাছায় ভরে গেছে। কলোনির মধ্যে থাকা মসজিদটিও সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে প্রধান ফটকটি। জেনারেটর ভবন ও পানির পাম্পের রুমগুলোর অবস্থা আরও করুণ।
তবে নগরীর সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৬নং রোডে অবস্থিত সাধারণ বীমা স্টাফ কলোনির একাধিক বাসিন্দা জানান, এ কলোনিটি বিক্রি করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছেন কর্পোরেশনের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। এর আগেও বীমা কর্পোরেশনের জায়গা অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল।
পানির দরে জায়গা বিক্রি : কলোনির একাধিক বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর আগে খুলশীর ২৮ কাঠা জায়গা অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে বীমা কর্পোরেশন। খুলশীর ওই জায়গাটি প্রায় ১৫ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করেছে মাত্র ৮ কোটি টাকা দামে। জায়গাটি কিনেছেন ঢাকার এবিসি নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। সাধারণ কর্পোরেশনের টাকার কোনো অভাব নেই অথচ মূল্যবান জায়গাটি পানির দরে বিক্রি করে দেয়ার পেছনে কিছু কর্মকর্তার হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক মহিলা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা পাশের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করে। বাসা ছেড়ে দিয়ে আমরা কোথায় যাব। যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। আবার বাসা ভাড়া কোথা থেকে দেব। তবে তারা ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
শত কোটি টাকার জায়গা বেদখল : চট্টগ্রামে বীমা কর্পোরেশনের পৃথক তিনটি কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। বেদখল হওয়া জায়গাগুলো হচ্ছে নগরীর লালখান বাজার এলাকার আলপাইন হিল, পটিয়া টি এস্টেট এবং রাঙ্গামাটিতে একটি জায়গা বেদখল হয়ে আছে। আলপাইন হিল নামের জায়গাটির পরিমাণ প্রায় ১ একর। যার বর্তমান বাজার মূল্য কয়েকশ’ কোটি টাকা। তবে আলপাইন হিল জায়গার জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশন বাদী হয়ে ২০০৭ সালে কেরামত আলী গংয়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ২য় সাব জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ১৬৯/২০০৭। মামলাটি বর্তমানে শুনানি পর্যায়ে রয়েছে বলে বীমা কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান।
তবে অন্য দুটি জায়গা উদ্ধারের ব্যাপারে কর্পোরেশন একেবারে নীরব। পটিয়া উপজেলার ২৬ একর টি এস্টেট জায়গাটির অবস্থানও বীমা কর্পোরেশন শনাক্ত করতে পারেনি। এমনকি জায়গাটি কারা অবৈধভাবে দখল করে আছে এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। অথচ চল্লিশ বছর ধরে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন প্রতিবছর ট্যাক্স ও খাজনা দিয়ে আসছে।
মদ ও জুয়ার আসর : সন্ধ্যা হলেই কর্পোরেশনের কলোনিটিতে বসে মদ ও গাঁজার আসর। সরেজমিনে দেখা যায়, কলোনির উত্তর পাশের ভবনের সঙ্গে লাগোয়া একটি চৌকি ও ছাউনি দিয়ে গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা ও মদের আসর বানানো হয়েছে। সারারাত ধরে চলে মাদক সেবনের কর্মযজ্ঞ। একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন এ আসর থেকে বিক্রি হয় কয়েক লাখ টাকার ইয়াবা। স্থানীয় অনেকে কলোনিটিতে ইয়াবা কলোনি বলে ডাকেন। স্থানীয় সাকিল, রফিক, জনি ও বিপ্লব এদের বিরুদ্ধে অবৈধ মাদক বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এরা সবাই এলাকার পাতি সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় লোকজন তাদের মুখ খুলতে সাহস পান না। ফলে তারা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এসব অপকর্ম।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জোনের ইনচার্জ ও ডিজিএম খসরু দস্তগীর আলম যুগান্তরকে জানান, বিভিন্ন সময় ভূমিকম্প ও মেরামতের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যয় নেমে এলে কিংবা প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার কে নেবে? এর ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে বাসা বরাদ্দ বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে কলোনিতে যারা থাকছেন তারা সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে থাকছেন। কোনো অঘটন ঘটলে সাধারণ বীমা কর্তৃপক্ষ তার দায়ভার নেবে না।
তিনি জানান, ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর বুয়েটের ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ কলোনির দালানগুলো পরিদর্শন করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদল ভবন পরীক্ষার জন্য ১৬ লাখ টাকা দাবি করেন। এতটাকা দাবি করায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পক্ষে ভবনগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৩ সালের ২ মে প্রধান কার্যালয়ের এক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক কলোনির বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
কর্পোরেশনের বিভিন্ন জায়গা বেদখল থাকা প্রসঙ্গে খসরু দস্তগীর আলম বলেন, লালখানবাজারের আলপাইন হিল জায়গাটি নিয়ে মামলা চলছে। বিবাদীদের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারা আদালতে আসছে না। ফলে মামলাটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পটিয়া টি এস্টেটে আমরা দখলে যেতে পারছি না। আমি পটিয়া ভূমি অফিসকেও কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। ফলে অনেক বছর ধরে জায়গাটির দখলে যেতে পারছি না। খুলশীর জায়গাটি কম মূল্যে বিক্রি সম্পর্কে তিনি বলেন, জায়গাটি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বিক্রি হয়েছে। এতে কর্পোরেশন লাভবান হয়েছে। জায়গাটি বিক্রি না করলে হয়তো এটিও বেদখল হয়ে যেত।

No comments

Powered by Blogger.